কুরআন অনুযায়ী সফল জীবনের মূলনীতি: দুনিয়া ও আখিরাতে সাফল্যের পথ

হালাল রিজিক কী? কুরআন ও হাদিসে হালাল রিজিকের গুরুত্বপ্রকৃত সফলতা শুধু দুনিয়ার আর্থিক অর্জনে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি আত্মিক শান্তি, নৈতিকতা ও আখিরাতের কল্যাণের সাথে জড়িত। কুরআন আমাদের সফল জীবনের জন্য কিছু মূলনীতি দিয়েছে, যা অনুসরণ করলে আমরা দুনিয়া ও আখিরাত—উভয় জগতে সফল হতে পারি।

আরো পড়ুনঃ ইসলামে ব্যবসার নীতিমালা: সফল ও বরকতময় ব্যবসার মূলনীতি

আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান রাখা

আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান (বিশ্বাস) রাখা হলো সফল জীবনের মূল ভিত্তি। কুরআন ও হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, যারা আল্লাহর প্রতি সত্যিকারের ঈমান রাখে, তাদের জীবন বরকতময় হয় এবং তারা দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হয়।

১. ঈমানের প্রকৃত অর্থ কী?

ঈমান শব্দটি আরবি "أمن" (আমান) ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো বিশ্বাস, নিরাপত্তা ও নিশ্চিত হওয়া। ইসলামি পরিভাষায়, ঈমান হলো—

আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা, কিতাবসমূহ, নবী-রাসূলগণ, পরকাল, তাকদির (ভাগ্য) ও মৃত্যুর পর পুনরুত্থানে দৃঢ় বিশ্বাস রাখা।

২. কুরআনে ঈমানের গুরুত্ব

আল্লাহ বলেন:

"যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে।"

— (সুরা আল-বাকারাহ: ৮২)

একটি সফল জীবন গড়তে হলে প্রথম শর্ত হলো, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখা এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা।

৩. ঈমানদারদের জন্য প্রতিশ্রুত পুরস্কার

কুরআনে আল্লাহ ঈমানদারদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন:

• শান্তিময় জীবন: "যে ব্যক্তি ঈমান আনে এবং নেক কাজ করে, আমি তাকে সুখময় জীবন দান করব।" — (সুরা আন-নাহল: ৯৭)
• আল্লাহর সাহায্য: "আল্লাহ ঈমানদারদের সাহায্য করেন এবং তাদের অভিভাবক।" — (সুরা আল-বাকারা: ২৫৭)
• গুনাহ মাফ: "যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, আমি তাদের গুনাহ মাফ করে দেব এবং উত্তম প্রতিদান দেব।" — (সুরা ত্বাগাবুন: ৯)

৪. ঈমান দৃঢ় করার উপায়

অনেক সময় মানুষের ঈমান দুর্বল হয়ে যায়। এটি শক্তিশালী করার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি—

• কুরআন পড়া ও বুঝা: কুরআন অধ্যয়ন করলে আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান বৃদ্ধি পায় এবং ঈমান মজবুত হয়।
• নামাজ কায়েম করা: নামাজ হলো ঈমানের প্রতিফলন। এটি আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করে।
• আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করা: জিকির ও দোয়ার মাধ্যমে হৃদয়ে ঈমান বৃদ্ধি পায়।
• সৎ সঙ্গ গ্রহণ করা: নেককার ও ধার্মিক ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে থাকলে ঈমান মজবুত হয়।
• আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করা: মহাবিশ্ব, প্রকৃতি ও জীবনের রহস্য নিয়ে চিন্তা করলে আল্লাহর মহত্ব উপলব্ধি করা যায়।

সফল জীবন অর্জনের প্রথম শর্ত হলো আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান রাখা। যারা আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখে, তাঁর আদেশ মেনে চলে, তারা কখনো ব্যর্থ হয় না। কুরআন আমাদের শিক্ষা দেয়—

"যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে, তাদের জন্য রয়েছে সুখকর পরিণাম।"

— (সুরা আন-নামল: ৮٩)

আল্লাহ আমাদের সবাইকে সত্যিকারের ঈমানদার বানান। আমিন!

আরো পড়ুনঃ কুরআনের আলোকে আধুনিক বিজ্ঞান: এক বিস্ময়কর তুলনা

নামাজ কায়েম করা

নামাজ ইসলাম ধর্মের প্রধান ইবাদতগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং এটি একজন মুমিনের জীবনে সফলতা অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কুরআন ও হাদিসে বারবার বলা হয়েছে যে, যারা নামাজ কায়েম করে, তারা দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হয়।

১. নামাজ কায়েম করার অর্থ কী?

"নামাজ কায়েম করা" বলতে কেবল নামাজ আদায় করাই বোঝায় না; বরং এটি নিয়মিত, সঠিক নিয়মে, বিনয় ও একাগ্রতার সঙ্গে নামাজ পড়ার বিষয়কে বোঝায়।

আল্লাহ বলেন:

"এরা তারা, যারা তাদের নামাজে বিনয় ও একাগ্রতা অবলম্বন করে।"

— (সুরা আল-মুমিনুন: ২)

নামাজের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলে, পাপ থেকে বিরত থাকে এবং জীবনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে।

২. কুরআনে নামাজের গুরুত্ব

আল্লাহ কুরআনে বহুবার নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

• সফলতার প্রতীক: "নিশ্চয়ই সফলতা অর্জন করেছে মুমিনগণ, যারা তাদের নামাজে বিনয়-নম্রতা অবলম্বন করে।" — (সুরা আল-মুমিনুন: ১-২)
• পাপ থেকে রক্ষা করে: "নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে।" — (সুরা আল-আনকাবুত: ৪৫)
• আল্লাহর সাহায্য লাভের মাধ্যম: "হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো।" — (সুরা আল-বাকারাহ: ১৫৩)

৩. নামাজ না পড়ার শাস্তি

নামাজ ছেড়ে দেওয়ার ফলে মানুষ জীবনে নানা সমস্যা ও বিপদে পড়ে।

ভন্ডদের চিহ্ন: 

"অতএব দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে উদাসীন।" — (সুরা আল-মাউন: ৪-৫)

জাহান্নামের কারণ: 

কিয়ামতের দিন জাহান্নামীদের প্রশ্ন করা হবে:

"তোমাদের কী হলো যে, তোমরা জাহান্নামে পড়লে?"

তারা বলবে: ‘আমরা নামাজ পড়তাম না।’"

— (সুরা আল-মুদ্দাসসির: ৪২-৪৩)

৪. নামাজের উপকারিতা

নামাজ কেবল একটি ইবাদত নয়; এটি মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

• আত্মিক প্রশান্তি: নামাজ মানুষের মনে প্রশান্তি ও তৃপ্তি এনে দেয়।
• জীবনে শৃঙ্খলা আনে: নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লে জীবনে সময়ানুবর্তিতা আসে।
• শারীরিক উপকারিতা: নামাজে বিভিন্ন শারীরিক ব্যায়াম রয়েছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
• পাপমুক্তি: নামাজ গুনাহ মুছে দেয়, যেমন পানি ময়লা ধুয়ে ফেলে।

রাসূল (সা.) বলেছেন:

"তোমাদের কেউ যদি প্রতিদিন পাঁচবার নদীতে গোসল করে, তাহলে কি তার শরীরে কোনো ময়লা অবশিষ্ট থাকবে?"

সাহাবিরা বললেন, ‘না’।

তিনি বললেন, ‘এটাই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের উদাহরণ, যা গুনাহ দূর করে দেয়।’"

— (বুখারি, মুসলিম)

৫. নামাজ কায়েম করার উপায়

অনেকে নামাজ পড়তে চাইলেও নিয়মিত হতে পারে না। নিচের কৌশলগুলো অনুসরণ করলে সহজ হবে—

• নামাজের গুরুত্ব বুঝুন: কুরআন ও হাদিস থেকে নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে জানলে মন থেকে আগ্রহ তৈরি হবে।
• নামাজের সময়সূচি মেনে চলুন: প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে নামাজ পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
• সত্‌সঙ্গ গ্রহণ করুন: যারা নিয়মিত নামাজ পড়ে, তাদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করুন।
• আল্লাহর ভয় রাখুন: কিয়ামতের দিন নামাজের হিসাব দিতে হবে— এটি মনে রাখুন।
• পরিবারের পরিবেশ তৈরি করুন: পরিবারের সবাই মিলে নামাজ পড়লে এটি অভ্যাসে পরিণত হবে।

নামাজ শুধু একটি ইবাদত নয়; এটি জীবনকে সুন্দর, সফল ও বরকতময় করার মাধ্যম। যারা নিয়মিত নামাজ পড়ে, তারা দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে নামাজ কায়েম করার তাওফিক দিন। আমিন!

আরো পড়ুনঃ ইসলামে বিনয় ও ধৈর্যের ফজিলত। একজন মুসলিমের জীবনে এর গুরুত্ব

পরিশ্রম ও ধৈর্য ধারণ করা

সফলতা কখনো হঠাৎ করে আসে না। এটি অর্জনের জন্য প্রয়োজন পরিশ্রম এবং ধৈর্য। ইসলাম আমাদের শেখায় যে, যে ব্যক্তি কঠোর পরিশ্রম করে এবং ধৈর্য ধারণ করে, সে দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হয়। কুরআন ও হাদিসে এই বিষয়ে অসংখ্য বাণী রয়েছে।

১. পরিশ্রম ও ধৈর্যের সংজ্ঞা

• পরিশ্রম: নিজের লক্ষ্য অর্জনের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো।
• ধৈর্য: কঠিন পরিস্থিতিতে হতাশ না হয়ে দৃঢ়ভাবে লড়ে যাওয়া এবং আল্লাহর উপর ভরসা রাখা।

আল্লাহ বলেন:

"যে কেউ পরিশ্রম করে, সে নিজের জন্যই পরিশ্রম করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বজগতের মুখাপেক্ষী নন।"

— (সুরা আনকাবুত: ৬)

২. কুরআনে পরিশ্রম ও ধৈর্যের গুরুত্ব

পরিশ্রমের ফলাফল:

"মানুষের জন্য তা-ই রয়েছে, যা সে চেষ্টা করে।"

— (সুরা আন-নাজম: ৩৯)

ধৈর্যশীলদের প্রতিদান:

"নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের প্রতিদান তাদের কর্মের সর্বোত্তম হিসেবে দেওয়া হবে।"

— (সুরা আন-নাহল: ৯৬)

সফলতার গোপন রহস্য:

"তোমরা যদি ধৈর্য ধারণ করো এবং তাকওয়া অবলম্বন করো, তবে কেউ তোমাদের ক্ষতি করতে পারবে না।"

— (সুরা আলে ইমরান: ১২০)

৩. হাদিসে পরিশ্রম ও ধৈর্যের গুরুত্ব

পরিশ্রমের মাধ্যমে রিজিক আসে:

রাসূল (সা.) বলেছেন—

"আল্লাহ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন সেই ব্যক্তিকে, যে নিজের হাতের উপার্জন খায়।"

— (বুখারি)

ধৈর্যশীলদের জন্য জান্নাত:

রাসূল (সা.) বলেছেন—

"যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করবে, আল্লাহ তাকে আরও ধৈর্যশীল হওয়ার শক্তি দেবেন।"

— (বুখারি ও মুসলিম)

পরিশ্রম ও দোয়া একসঙ্গে করতে হবে:

এক সাহাবি রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, "আমি কি শুধু দোয়া করব, নাকি পরিশ্রম করব?"

তিনি উত্তর দিলেন—

"তুমি তোমার উটের রশি বেঁধে দোয়া করো।"

— (তিরমিজি)

৪. পরিশ্রম ও ধৈর্য না থাকলে কী হয়?

• ব্যর্থতা ও হতাশা: পরিশ্রম ছাড়া কেউ সফল হতে পারে না। ধৈর্য ছাড়া মানুষ দ্রুত হতাশ হয়ে যায়।
• আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চিত হওয়া: আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে সাহায্য করেন, যে চেষ্টা চালিয়ে যায়।
• জীবনের শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যাওয়া: ধৈর্য ও পরিশ্রম ছাড়া জীবনে শৃঙ্খলা থাকে না।

৫. পরিশ্রম ও ধৈর্য অর্জনের উপায়

• আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন: মনে রাখুন, আল্লাহ পরিশ্রমী ও ধৈর্যশীলদের পছন্দ করেন।
• লক্ষ্য নির্ধারণ করুন: আপনার জীবনের উদ্দেশ্য কী তা ঠিক করুন এবং সেই অনুযায়ী পরিশ্রম করুন।
• ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন: সবকিছু রাতারাতি হয়ে যায় না। সময় দিতে হবে।
• নিয়মিত দোয়া করুন: দোয়া ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য কামনা করুন।
• কঠিন সময়েও আশা হারাবেন না: ধৈর্যশীলরা কখনো হতাশ হয় না। তারা বিশ্বাস রাখে, সফলতা আসবেই।

পরিশ্রম ও ধৈর্য—এই দুটি গুণ জীবনে সফলতা অর্জনের জন্য অপরিহার্য। কুরআন ও হাদিস আমাদের শেখায় যে, যারা ধৈর্য ধরে কঠোর পরিশ্রম করে, তারা অবশ্যই আল্লাহর রহমতে সফলতা অর্জন করে।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে পরিশ্রম ও ধৈর্য ধারণ করার তৌফিক দান করুন। আমিন!

আরো পড়ুনঃ কুরআনে উল্লেখিত বৈজ্ঞানিক তথ্য— বিজ্ঞানের আলোকে চমকপ্রদ সত্য

সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকা

সত্য ও ন্যায়পরায়ণতা ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। একজন মুসলমানের জীবনে সফলতা অর্জনের জন্য সত্যবাদী ও ন্যায়ের পথে থাকা অপরিহার্য। কুরআন ও হাদিসে বারবার সত্য বলার ও ন্যায়বিচারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যারা এই গুণগুলো অর্জন করে, তারা দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হয়।

১. সত্য ও ন্যায়ের সংজ্ঞা

• সত্য: সত্য বলতে সঠিক, নির্ভরযোগ্য ও বাস্তবতাভিত্তিক কথা বলা ও কাজ করাকে বোঝায়।
• ন্যায়: ন্যায় বা ইনসাফ হলো ন্যায্য ও সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া, কারও প্রতি অবিচার না করা এবং সকলের অধিকার সংরক্ষণ করা।

আল্লাহ বলেন—

"হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো, আল্লাহর জন্য সাক্ষ্য দিও, যদিও তা তোমাদের নিজের, বাবা-মা কিংবা আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে যায়।"

— (সুরা আন-নিসা: ১৩৫)

২. কুরআনে সত্য ও ন্যায়ের গুরুত্ব

সত্যবাদীদের জন্য জান্নাত:

"এ দিন সত্যবাদীদের সত্যতার উপকার হবে। তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হবে নদী। সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে।"

— (সুরা আল-মায়েদা: ১১৯)

ন্যায়পরায়ণরা আল্লাহর প্রিয়:

"নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।"

— (সুরা আল-মায়েদা: ৪২)

অন্যায় থেকে দূরে থাকার নির্দেশ:

"অন্যায়ের দিকে ঝুঁকো না, তা না হলে জাহান্নামের আগুন তোমাদের স্পর্শ করবে।"

— (সুরা হুদ: ১১৩)

৩. হাদিসে সত্য ও ন্যায়ের গুরুত্ব

সত্যবাদিতা জান্নাতে নিয়ে যায়:

রাসূল (সা.) বলেছেন—

"তোমরা সর্বদা সত্য কথা বলো, কারণ সত্য নেকির দিকে নিয়ে যায়, আর নেকি জান্নাতে পৌঁছে দেয়।"

— (বুখারি, মুসলিম)

ন্যায়বিচার আল্লাহর ছায়ায় থাকবে:

রাসূল (সা.) বলেন—

"কিয়ামতের দিন সাত শ্রেণির মানুষ আল্লাহর আরশের ছায়ায় থাকবে, তাদের মধ্যে একজন হলো ন্যায়পরায়ণ শাসক।"

— (বুখারি, মুসলিম)

মিথ্যা ধ্বংসের কারণ:

"তোমরা মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকো, কারণ মিথ্যা পাপের দিকে নিয়ে যায়, আর পাপ জাহান্নামে প্রবেশ করায়।"

— (বুখারি, মুসলিম)

৪. সত্য ও ন্যায়ের অভাব হলে কী হয়?

• অবিশ্বাস ও অন্যায়ের বিস্তার ঘটে
• সমাজে অশান্তি ও অবিচার বাড়ে
• মানুষ আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়
• জাহান্নামের শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়

আল্লাহ বলেন:

"যারা সত্যকে গোপন করে এবং মিথ্যা প্রচার করে, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।"

— (সুরা আল-বাকারাহ: ১৫৯)

৫. কীভাবে সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকা যায়?

• আল্লাহর ভয় রাখুন: মনে রাখুন, আল্লাহ সবকিছু দেখছেন।
• মিথ্যা ও অন্যায় থেকে দূরে থাকুন: সত্য বলার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
• ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নিন: নিজের স্বার্থের জন্য কখনো অন্যায় সমর্থন করবেন না।
• সত্‌সঙ্গ গ্রহণ করুন: ভালো মানুষদের সাথে থাকুন, যারা সত্যবাদী ও ন্যায়পরায়ণ।
• নিয়মিত কুরআন ও হাদিস অধ্যয়ন করুন: এগুলো সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে সাহায্য করবে।

সত্য ও ন্যায়পরায়ণতা শুধু ভালো গুণই নয়, এটি সফলতার মূল চাবিকাঠি। যে ব্যক্তি সত্যবাদী ও ন্যায়ের পথে থাকে, সে দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকার তাওফিক দান করুন।

আমিন!

আরো পড়ুনঃ প্রতিদিনের জীবনে রাসূল (সা.)-এর সুন্নতগুলো অনুসরণের উপকারিতা

অহংকার পরিহার করা

অহংকার মানুষের চরিত্রের এক ভয়ংকর দোষ, যা তাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। ইসলাম অহংকারকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে এবং নম্রতা ও বিনয়কে উৎসাহিত করেছে। যারা অহংকার করে, তারা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয় এবং তাদের পরিণতি ভয়াবহ হয়।

১. অহংকারের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ

অহংকার (কিবর): নিজেকে অন্যদের চেয়ে বড় মনে করা এবং অন্যদের হেয় মনে করা।

প্রকারভেদ:

• নিজেকে সবার চেয়ে উত্তম মনে করা – যেমন ইবলিস আদম (আ.)-কে হেয় করে বলেছিল, "আমি তার চেয়ে ভালো, তুমি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছো, আর তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছো।" (সুরা আল-আরাফ: ১২)
• অন্যদের অবজ্ঞা করা – মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা।
• সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা – নিজের ভুল না মানা ও অহংকারবশত সত্য অস্বীকার করা।

২. কুরআনে অহংকারের পরিণতি

অহংকারীরা আল্লাহর রহমত পায় না:

"নিশ্চয়ই আল্লাহ অহংকারী ও দাম্ভিকদের পছন্দ করেন না।"

— (সুরা আন-নাহল: ২৩)

অহংকার ধ্বংস ডেকে আনে:

"আমি তাদের হৃদয়ে অহংকার সঞ্চার করব, যারা অন্যায়ভাবে পৃথিবীতে বড়ত্ব দেখায়।"

— (সুরা আল-আরাফ: ১৪৬)

অহংকারীদের স্থান জাহান্নাম:

"জাহান্নামবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে নিচু স্তরে থাকবে অহংকারী ও অবিশ্বাসীরা।"

— (সুরা আন-নিসা: ১৪৫)

৩. হাদিসে অহংকারের ভয়াবহতা

জান্নাতে প্রবেশ নিষিদ্ধ:

রাসূল (সা.) বলেছেন—

"যার অন্তরে এক অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।"

— (মুসলিম: ৯১)

সত্যকে অস্বীকার ও মানুষকে হেয় করা অহংকার:

"অহংকার হলো সত্য প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করা।"

— (মুসলিম: ৯১)

নম্রতা আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন করে:

রাসূল (সা.) বলেন—

"আল্লাহ যার প্রতি দয়া করেন, তিনি তাকে নম্র করেন এবং তাকে ঊর্ধ্বে উঠান।"

— (মুসলিম: ২৫৮৮)

৪. অহংকারের ফলাফল

• আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়া
• মানুষের ঘৃণা অর্জন করা
• সত্য ও ন্যায়বিচার থেকে বিচ্যুত হওয়া
• জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করা

আল্লাহ বলেন:

"অবশ্যই যারা অহংকার করে, আমি তাদের কঠিন শাস্তি দেবো।"

— (সুরা আল-গাফির: ৩৫)

৫. অহংকার থেকে মুক্ত থাকার উপায়

• আল্লাহর কাছে দোয়া করা: অহংকার থেকে বাঁচার জন্য নিয়মিত দোয়া করুন।
• নিজেকে দীন ও দুর্বল ভাবা: মনে রাখুন, আল্লাহ ছাড়া আমরা কেউ কিছুই নই।
• মানুষের প্রতি নম্র হওয়া: বড়ত্ব দেখানোর পরিবর্তে অন্যদের সম্মান দিন।
• সত্য গ্রহণ করা: নিজের ভুল বুঝলে তা স্বীকার করতে শিখুন।
• রাসূল (সা.)-এর জীবন অনুসরণ করা: তিনি সর্বদা নম্র ও বিনয়ী ছিলেন।

অহংকার ধ্বংসের পথ, আর বিনয় সফলতার চাবিকাঠি। যারা অহংকার করে, তারা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়, আর যারা নম্র থাকে, তারা দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হয়। আল্লাহ আমাদের অহংকার থেকে রক্ষা করুন এবং বিনয়ী হওয়ার তাওফিক দান করুন।

আমিন!

সততা ও আমানতদারি বজায় রাখা

সততা ও আমানতদারি হলো ইসলামের মৌলিক নীতি, যা একজন মুমিনের চরিত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কুরআন ও হাদিসে বারবার সততা ও আমানতদারির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, কারণ এগুলো মানুষের পারস্পরিক বিশ্বাস ও সমাজের নৈতিক ভিত্তিকে দৃঢ় করে। যে ব্যক্তি সততা ও আমানতদারি বজায় রাখে, সে আল্লাহর কাছে প্রিয় এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা অর্জন করে।

১. সততা ও আমানতদারির সংজ্ঞা

• সততা: সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকা, মিথ্যা ও প্রতারণা থেকে দূরে থাকা।
• অমানতদারি: কাউকে দেওয়া দায়িত্ব বা সম্পদ যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করা, প্রতারণা করা।

আল্লাহ বলেন—

"নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দেন, তোমরা আমানত তার উপযুক্ত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দাও এবং মানুষদের মধ্যে যখন বিচার করো, তখন ন্যায়বিচার করো।"

— (সুরা আন-নিসা: ৫৮)

২. কুরআনে সততা ও আমানতদারির গুরুত্ব

সততা জান্নাতে নিয়ে যায়:

"যারা সততার সাথে জীবন যাপন করে, তারা আল্লাহর নিকট প্রিয় এবং তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত।"

— (সুরা আল-মায়েদা: ১১৯)

অমানতদারদের শাস্তি:

"যে ব্যক্তি আমানত ভঙ্গ করে, কিয়ামতের দিন সে তা বহন করে আসবে।"

— (সুরা আলে ইমরান: ১৬১)

সততা ব্যবসা ও লেনদেনে বরকত আনে:

"তোমরা ওজন ও মাপে সম্পূর্ণতা দাও এবং মানুষের অধিকারে কমতি করো না।"

— (সুরা আল-আনআম: ১৫২)

৩. হাদিসে সততা ও আমানতদারির গুরুত্ব

সততা নবীদের গুণ:

রাসূল (সা.) বলেন—

"তোমরা সততা অবলম্বন করো, কারণ সততা নেকির দিকে নিয়ে যায় এবং নেকি জান্নাতে পৌঁছে দেয়।"

— (বুখারি, মুসলিম)

অমানতদার মুনাফিক:

"যার মধ্যে আমানতদারি নেই, তার মধ্যে ঈমান নেই।"

— (মুসলিম: ৩৩)

সততার পুরস্কার:

রাসূল (সা.) বলেন—

"সৎ ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।"

— (তিরমিজি: ১২০৯)

৪. সততা ও আমানতদারি না থাকলে কী হয়?

• সমাজে অবিশ্বাস ও অশান্তি সৃষ্টি হয়
• অর্থনৈতিক সংকট ও ধ্বংস নেমে আসে
• মানুষ আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়
• কিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়

রাসূল (সা.) বলেছেন:

"যখন আমানতদারি নষ্ট হয়ে যাবে, তখন কিয়ামতের জন্য প্রস্তুত হও।"

— (বুখারি: ৫৯)

৫. কীভাবে সততা ও আমানতদারি বজায় রাখা যায়?

• আল্লাহর ভয় রাখুন: মনে রাখুন, আল্লাহ সবকিছু দেখছেন।
• অন্যের অধিকার নষ্ট করবেন না: লেনদেনে সততা বজায় রাখুন।
• কাউকে দেওয়া দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করুন।
• সত্য কথা বলুন ও প্রতারণা পরিহার করুন।
• রাসূল (সা.)-এর জীবনের অনুসরণ করুন।

সততা ও আমানতদারি ইসলামী জীবনের অন্যতম মূলনীতি। যে ব্যক্তি এই গুণ অর্জন করে, সে দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সততা ও আমানতদারি বজায় রাখার তাওফিক দান করুন।

আমিন!

পরোপকারিতা ও দানশীলতা

ইসলামে পরোপকারিতা ও দানশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ। এটি শুধু দুনিয়ায় শান্তি ও ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয় না, বরং আখিরাতেও জান্নাতের পথ সুগম করে। দান-সদকা ও অন্যদের উপকার করার মাধ্যমে একজন মুমিন আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারে।

১. পরোপকারিতা ও দানশীলতার সংজ্ঞা

• পরোপকারিতা: নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে অন্যের কল্যাণে কাজ করা।
• দানশীলতা: আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সম্পদ ও সামর্থ্য থেকে অভাবীদের সাহায্য করা।

আল্লাহ বলেন:

"যারা আল্লাহর পথে স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তারা সেই বীজের মতো, যা থেকে সাতটি শীষ বের হয় এবং প্রতিটি শীষে একশতটি করে দানা থাকে।"

— (সুরা আল-বাকারা: ২৬১)

২. কুরআনে দানশীলতা ও পরোপকারের গুরুত্ব

আল্লাহ দানকারীদের ভালোবাসেন:

"যারা নিজেদের সম্পদ গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তাদের জন্য প্রতিদান রয়েছে আল্লাহর কাছে।"

— (সুরা আল-বাকারা: ২৭৪)

দান করলে সম্পদ বৃদ্ধি পায়:

"যারা আল্লাহর জন্য ব্যয় করে, আল্লাহ তাদের সম্পদ বহুগুণ বাড়িয়ে দেন।"

— (সুরা সাবা: ৩৯)

গরিবদের প্রতি দয়ালু হওয়া ইসলামের শিক্ষা:

"তুমি কখনো অভাবীদের ধমক দিও না, আর তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহের কথা বলো।"

— (সুরা আদ-দুহা: ১০-১১)

৩. হাদিসে দানশীলতা ও পরোপকারের গুরুত্ব

দান জান্নাতের পথ:

রাসূল (সা.) বলেন—

"দান-সদকা জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করে।"

— (তিরমিজি: ৬০৪)

দান করলে সম্পদ কমে না:

"দান করলে সম্পদ কখনো কমে না, বরং তা বৃদ্ধি পায়।"

— (মুসলিম: ২৫৮৮)

সবচেয়ে উত্তম দান:

"সবচেয়ে উত্তম দান হলো, যখন তুমি সুস্থ ও সম্পদের প্রতি লোভী থাকা অবস্থায় দান করো।"

— (বুখারি: ১৪১৯)

৪. দানশীলতা ও পরোপকারের উপকারিতা

• আল্লাহর রহমত ও বরকত লাভ হয়
• সম্পদ বাড়ে ও দুঃখ-কষ্ট দূর হয়
• পরিবার ও সমাজে ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়
• আখিরাতে জান্নাত লাভ হয়

রাসূল (সা.) বলেছেন:

"পরোপকারী ব্যক্তি আল্লাহর ছায়ায় থাকবে, যখন আর কোনো ছায়া থাকবে না।"

— (বুখারি: ১৪২১)

৫. কিভাবে দানশীলতা ও পরোপকারিতা বাড়ানো যায়?

• নিয়মিত দান করা: সামর্থ্য অনুযায়ী গরিবদের সাহায্য করুন।
• অহংকার না করা: দান গোপনে করা উত্তম।
• মানুষের বিপদে পাশে থাকা: সাহায্য করা শুধু টাকার মাধ্যমে নয়, সময় ও শ্রম দিয়েও করা যায়।
• মিষ্টিভাষী হওয়া: কারও প্রতি সদয় আচরণ করাও পরোপকার।

পরোপকারিতা ও দানশীলতা একজন মুসলিমের জন্য শুধু দায়িত্বই নয়, বরং এটি তাকে জান্নাতের পথ দেখায়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে দানশীল ও পরোপকারী হওয়ার তাওফিক দিন।

আমিন!

পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া

পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। একজন মুসলিম শুধু নিজের জন্য বাঁচে না, বরং পরিবার ও সমাজের প্রতি তার দায়িত্ব রয়েছে। কুরআন ও হাদিসে বারবার পরিবার ও সমাজের কল্যাণে কাজ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কারণ একটি সুসংগঠিত পরিবার ও সমাজই ইসলামের শক্ত ভিত্তি গড়ে তোলে।

১. পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতার গুরুত্ব

• পরিবারের দায়িত্ব: সন্তান, স্ত্রী, পিতা-মাতার প্রতি যত্নশীল হওয়া।
• সমাজের দায়িত্ব: প্রতিবেশী, গরিব-দুঃখী ও সমাজের সকল মানুষের কল্যাণে কাজ করা।

আল্লাহ বলেন:

"হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।"

— (সুরা আত-তাহরিম: ৬)

২. কুরআনে পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব সম্পর্কে নির্দেশনা

পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব:

"তোমার রব নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করো।"

— (সুরা আল-ইসরা: ২৩)

স্ত্রী ও সন্তানের দায়িত্ব:

"তোমাদের স্ত্রী ও সন্তান তোমাদের জন্য পরীক্ষা, কাজেই তাদের ব্যাপারে সাবধান থাকো।"

— (সুরা আত-তাগাবুন: ১৫)

সমাজের দুর্বলদের সাহায্য করা:

"তোমরা নামাজ কায়েম করো, যাকাত দাও এবং নেক কাজের আদেশ করো ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখো।"

— (সুরা তাওবা: ৭১)

৩. হাদিসে পরিবার ও সমাজের দায়িত্বশীলতার গুরুত্ব

সন্তানদের উত্তম শিক্ষা দেওয়া:

"তোমাদের প্রত্যেকেই একজন রক্ষক, এবং তোমরা তোমাদের অধীনস্থদের বিষয়ে দায়িত্বশীল।"

— (বুখারি, মুসলিম)

প্রতিবেশীর হক রক্ষা করা:

রাসূল (সা.) বলেন—

"যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীর কষ্টের কারণ হয়, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।"

— (তিরমিজি: ১৯৪৪)

গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করা:

"যে ব্যক্তি অনাথ ও গরিবদের দেখাশোনা করে, সে জান্নাতে আমার সঙ্গে থাকবে।"

— (বুখারি: ৬০০৫)

৪. পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতার উপকারিতা

• পরিবারে সুখ ও শান্তি বজায় থাকে
• সমাজে ন্যায়বিচার ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়
• আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়
• জান্নাতে স্থান পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়

৫. দায়িত্বশীল হওয়ার উপায়

• পরিবারের প্রতি যত্নশীল হওয়া – পিতা-মাতা, স্ত্রী, সন্তানদের প্রয়োজন পূরণ করা।
• প্রতিবেশীদের প্রতি সদয় হওয়া – তাদের বিপদে পাশে থাকা।
• সমাজের অসহায়দের সাহায্য করা – দান-সদকা ও মানবিক সহায়তা করা।
• ন্যায় ও সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো – অন্যায়ের প্রতিবাদ করা।
• শিক্ষা ও ভালো কাজের প্রচার করা – সমাজে নৈতিকতা বজায় রাখা।

পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া একজন প্রকৃত মুসলিমের পরিচয়। যদি সবাই তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে, তবে সমাজে শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে দায়িত্বশীল হওয়ার তাওফিক দান করুন।

আমিন!

সদাচার ও উত্তম আচরণ বজায় রাখা

ইসলাম শুধু নামাজ, রোজা বা অন্যান্য ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। কুরআন ও হাদিসে সদাচার ও উত্তম আচরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একজন মুসলিমের উচিত সর্বদা সত্য, ন্যায়ের পথে থাকা এবং মানুষদের প্রতি সদয় আচরণ করা।

১. সদাচার ও উত্তম আচরণের সংজ্ঞা

• সদাচার: নৈতিক ও শিষ্টাচারপূর্ণ ব্যবহার করা।
• উত্তম আচরণ: বিনয়ী, নম্র ও সহানুভূতিশীল হয়ে অন্যদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা।

আল্লাহ বলেন:

"তুমি ক্ষমাকে গ্রহণ করো, সৎকর্মের আদেশ দাও এবং মূর্খদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও।"

— (সুরা আল-আ'রাফ: ১৯৯)

২. কুরআনে সদাচার ও উত্তম আচরণের গুরুত্ব

সৎভাবে কথা বলা:

"তোমরা মানুষদের সাথে উত্তমভাবে কথা বলো।"

— (সুরা আল-বাকারা: ৮৩)

দয়ালু ও ক্ষমাশীল হওয়া:

"যারা মানুষের প্রতি রাগ সংবরণ করে এবং ক্ষমা করে, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন।"

— (সুরা আলে ইমরান: ১৩৪)

অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া:

"তুমি যদি কঠোর ও রূঢ় স্বভাবের হতে, তবে তারা তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যেত।"

— (সুরা আলে ইমরান: ১৫৯)

৩. হাদিসে সদাচার ও উত্তম আচরণের গুরুত্ব

উত্তম চরিত্র জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম:

রাসূল (সা.) বলেছেন—

"উত্তম চরিত্রের কারণে মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে।"

— (তিরমিজি: ২০০২)

সদাচার একজন প্রকৃত মুসলিমের পরিচয়:

"তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম, যার চরিত্র সবচেয়ে ভালো।"

— (বুখারি: ৬০৩৫)

অন্যদের প্রতি সদয় হলে আল্লাহও সদয় হন:

"যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন না।"

— (বুখারি: ৬০১৩)

৪. সদাচার ও উত্তম আচরণের উপকারিতা

• মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায়
• পরিবার ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়
• আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়
• জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হয়

৫. সদাচার বজায় রাখার উপায়

• সবসময় সত্য কথা বলা
• অন্যদের প্রতি নম্র ও দয়ালু হওয়া
• ক্রোধ সংবরণ করা
• পরিবার, বন্ধু ও প্রতিবেশীদের প্রতি সদয় আচরণ করা
• ক্ষমাশীল হওয়া ও ছোটখাটো ভুলগুলো মাফ করে দেওয়া

সদাচার ও উত্তম আচরণ শুধু দুনিয়ার জন্য নয়, আখিরাতেও কল্যাণ বয়ে আনে। একজন মুসলিমের উচিত সর্বদা সুন্দর ও মার্জিত ব্যবহার করা, যা কুরআন ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী উত্তম চরিত্র গঠনে সহায়তা করবে।

আমিন!

আখিরাতের কথা স্মরণ করা

আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস ও তা স্মরণ রাখা ইসলামি জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। একজন প্রকৃত মুমিন সবসময় মনে রাখে যে, দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, আর আখিরাতই চিরস্থায়ী জীবন। তাই সফলতার জন্য শুধু দুনিয়াবি স্বার্থ চিন্তা করলে চলবে না, বরং আখিরাতের জন্যও প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি।

১. আখিরাত স্মরণের গুরুত্ব

দুনিয়া অস্থায়ী, আখিরাত স্থায়ী:

আল্লাহ বলেন—

"এই দুনিয়ার জীবন শুধু ভোগ-বিলাস ও খেলা-তামাশা, আর পরকালই হলো প্রকৃত জীবন, যদি তোমরা জানতে!"

— (সুরা আল-আনকাবুত: ৬৪)

আখিরাত ভুলে গেলে মানুষ পথভ্রষ্ট হয়:

"তারা জানে দুনিয়াতে কীভাবে ভালো জীবনযাপন করতে হয়, কিন্তু আখিরাত সম্পর্কে তারা গাফিল।"

— (সুরা আর-রুম: ৭)

যে আখিরাতের জন্য কাজ করে, সে প্রকৃত সফল:

"যে ব্যক্তি আখিরাতের জন্য কাজ করে, আমি তার জন্য দুনিয়াতেও বরকত দিই।"

— (সুরা আল-ইসরা: ১৯)

২. হাদিসে আখিরাত স্মরণের গুরুত্ব

বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি যে মৃত্যুর প্রস্তুতি নেয়:

রাসূল (সা.) বলেছেন—

"সবচেয়ে বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করে এবং তার জন্য প্রস্তুতি নেয়।"

— (তিরমিজি: ২৪৫৯)

আখিরাতের কথা স্মরণ করলে পাপ কমে যায়:

"যদি তোমরা মৃত্যু ও আখিরাতের কথা বেশি বেশি স্মরণ কর, তবে তোমাদের পাপ কমে যাবে।"

— (বুখারি, মুসলিম)

দুনিয়ায় পরিশ্রম করলে আখিরাতে প্রতিদান পাওয়া যাবে:

"তোমরা জান্নাতের সেই ঘরের জন্য কাজ করো, যার ছাদ হবে আল্লাহর আরশ।"

— (তিরমিজি: ২৫৫৬)

৩. আখিরাতের কথা স্মরণ রাখার উপকারিতা

• পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা যায়
• মানুষ ন্যায় ও সত্যের পথে থাকে
• আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হয়
• দুনিয়ার মোহ কমে যায়
• সৎকর্মে আগ্রহ বাড়ে

৪. কীভাবে আখিরাতের কথা বেশি বেশি স্মরণ করা যায়?

• নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করা – এতে আখিরাতের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়।
• মৃত্যু ও কবরের কথা চিন্তা করা – এতে দুনিয়ার মোহ কমে আসে।
• প্রতিদিন কিছু নেক আমল করা – যেমন দান-সদকা, নামাজ, জিকির করা।
• মহান ব্যক্তিদের জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া – যারা আখিরাতকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
• আল্লাহর ভয় অন্তরে রাখা – গুনাহের সময় মনে করা, "আল্লাহ আমাকে দেখছেন।"

আখিরাতের কথা স্মরণ করা আমাদের দুনিয়াকে সুন্দর ও গুনাহমুক্ত করতে সাহায্য করে। যারা আখিরাতের জন্য কাজ করে, আল্লাহ তাদের দুনিয়াতেও সম্মানিত করেন এবং পরকালেও জান্নাত দেন। আসুন, আমরা আখিরাতের কথা ভুলে না যাই এবং তদনুযায়ী জীবন পরিচালনা করি।

আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন! আমিন!

শেষকথাঃ উপসংহার

সফল জীবন শুধু দুনিয়াবি অর্জনের উপর নির্ভরশীল নয়; বরং এটি আত্মিক শান্তি, নৈতিক মূল্যবোধ ও আখিরাতের কল্যাণের সাথে গভীরভাবে জড়িত। কুরআন আমাদের সত্য, ন্যায়, ধৈর্য, পরিশ্রম, দানশীলতা ও সদাচারের মতো গুণাবলি অর্জনের নির্দেশনা দিয়েছে, যা প্রকৃত সফলতার পথ দেখায়। যারা আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখে, নামাজ কায়েম করে, সততা ও ন্যায়বিচারের পথে চলে এবং আখিরাতের কথা স্মরণ রাখে, তারাই প্রকৃত সফল ব্যক্তি। আসুন, আমরা কুরআনের নির্দেশনা অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতার পথে এগিয়ে যাই।