সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের ফজিলত ও তাৎপর্য

Sabbir Space💲

5 Dec, 2024

পবিত্র কোরআন মুসলমানদের জীবনযাপনের পথপ্রদর্শক। এর প্রতিটি আয়াতই অফুরন্ত জ্ঞান ও রহমতের উৎস। তবে সূরা হাশরের শেষ তিনটি আয়াতের রয়েছে বিশেষ মর্যাদা ও ফজিলত। এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ তাআলার গুণাবলি ও মহিমা বর্ণিত হয়েছে।

সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের ফজিলত ও তাৎপর্য

আয়াতগুলোর নিয়মিত তিলাওয়াত করলে দুনিয়া ও আখিরাতে অশেষ কল্যাণ লাভ করা যায়। এখানে আমরা সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের বিস্তারিত ফজিলত, তাৎপর্য এবং এর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত (২২-২৪)

আয়াত ২২:

“তিনি আল্লাহ, যিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তিনি দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য সমস্ত কিছুর জ্ঞান রাখেন। তিনিই করুণাময়, পরম দয়ালু।”

আয়াত ২৩:

“তিনি আল্লাহ, যিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তিনি রাজাধিরাজ, পবিত্র, শান্তি প্রদানকারী, নিরাপত্তা দানকারী, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, মহাশক্তিশালী, সর্বশক্তিমান ও অহংকারমুক্ত। আল্লাহ পবিত্র তাদের থেকে, যাদেরকে তারা তাঁর সাথে শরিক করে।”

আয়াত ২৪:

“তিনি আল্লাহ, যিনি স্রষ্টা, বিন্যাসকারী, রূপদাতা। সুন্দরতম নামসমূহ তাঁরই। আসমান ও জমিনে যা কিছু রয়েছে সবই তাঁর মহিমা ঘোষণা করে। তিনিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”

আরো পড়ুনঃ কোরআন ও হাদিসের আলোকে নারীর অধিকারঃ ইসলামে নারীর অধিকার

আয়াতগুলোর মূল বিষয়বস্তু ও তাৎপর্য

এই তিন আয়াতে আল্লাহর বিভিন্ন গুণাবলি ও মহিমা তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে আল্লাহর জ্ঞান, করুণা, ক্ষমতা ও প্রজ্ঞার বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহর ১৫টি গুণের কথা বলা হয়েছে, যা মুসলমানদের জন্য আল্লাহকে সঠিকভাবে চেনার এবং তাঁর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশের পথ দেখায়।

আল্লাহর ১৫টি গুণাবলি:

আল-মালিক: তিনিই সবকিছুর মালিক ও শাসক।
আল-কুদ্দুস: তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র।
আস-সালাম: তিনি শান্তি ও নিরাপত্তার উৎস।
আল-মু’মিন: তিনি নিরাপত্তা দানকারী।
আল-মুহাইমিন: তিনিই রক্ষাকারী ও পর্যবেক্ষক।
আল-আজিজ: তিনি পরাক্রমশালী।
আল-জাব্বার: তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
আল-মুতাকাব্বির: তিনি অহংকারমুক্ত এবং সর্বোচ্চ।
আল-খালিক: তিনি স্রষ্টা।
আল-বারি: তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন বিন্যাস করে।
আল-মুসাওয়ার: তিনিই সৃষ্টিকে আকৃতি দিয়েছেন।
আল-হাকিম: তিনি প্রজ্ঞাময়।
আল-আলিম: তিনি সর্বজ্ঞানী।
আর-রহমান: তিনি অসীম করুণাময়।
আর-রহিম: তিনি পরম দয়ালু।

সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের ফজিলত

গুনাহ মাফের উপায়: হাদিসে উল্লেখ আছে, যে ব্যক্তি রাতে শোবার আগে এই তিনটি আয়াত তিলাওয়াত করবে, তার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। বিশেষত, ছোটখাট গুনাহগুলোর জন্য এটি এক বিশেষ রহমত।
জিন ও শয়তানের প্রভাব থেকে মুক্তি: এই আয়াতগুলো পাঠ করলে জিন ও শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলার গুণাবলি পাঠ করার মাধ্যমে তাঁর হেফাজতে থাকা যায়।
আল্লাহর নৈকট্য লাভ: আল্লাহর গুণাবলি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা এবং তা তিলাওয়াত করলে একজন মুমিন আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে। আখিরাতে এর জন্য আল্লাহ বিশেষ পুরস্কার দেবেন।
হৃদয় ও আত্মার প্রশান্তি: এই আয়াতগুলো পাঠ করলে মুমিনের হৃদয় প্রশান্ত হয়। আল্লাহর প্রশংসা করার ফলে আত্মা শান্তি লাভ করে এবং দুনিয়ার নানা দুশ্চিন্তা দূর হয়।
রোগমুক্তি ও বিপদ থেকে রক্ষা: অনেক ইসলামী স্কলার বলেছেন, যে ব্যক্তি নিয়মিত এই আয়াতগুলো পাঠ করে, আল্লাহ তাকে রোগ ও বিপদ থেকে রক্ষা করেন। বিশেষত, কঠিন পরিস্থিতিতে আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার জন্য এটি অত্যন্ত কার্যকর।
দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা: এই আয়াতগুলো পড়া শুধু দুনিয়ার জন্য নয়, আখিরাতেও মুমিনদের জন্য সফলতা বয়ে আনে। আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে গভীর ধারণা লাভ করে একজন মুমিন তার জীবনে সফল হতে পারে।
অন্যায় থেকে বিরত থাকা: আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে জানার ফলে মানুষ অন্যায় কাজ থেকে দূরে থাকে। আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতার কথা চিন্তা করে একজন মুমিন আল্লাহভীতি অর্জন করে।

আরো পড়ুনঃ হালাল উপার্জনঃ সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। হালাল রুজির গুরুত্ব

আয়াতগুলোর দোয়া হিসেবে ব্যবহার

সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত শুধু তিলাওয়াতের জন্য নয়, দোয়া হিসেবে ব্যবহার করাও অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। এগুলো আল্লাহর গুণাবলি ও মহিমা বর্ণনা করে, যা দোয়া করার সময় আল্লাহর প্রশংসা ও মহিমা বর্ণনা করার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। নিচে দোয়া হিসেবে ব্যবহার করার কিছু পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো:

১. আল্লাহর প্রশংসা ও মহিমা উল্লেখ করে দোয়া:

এই আয়াতগুলোতে আল্লাহর গুণাবলি বর্ণিত হয়েছে। দোয়া শুরু করার আগে আল্লাহর প্রশংসা করা সুন্নত। তাই দোয়ার শুরুতে এই আয়াতগুলো পাঠ করে আল্লাহর গুণগান করলে দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

উদাহরণ: আল-মালিক, আল-কুদ্দুস, আস-সালাম, আল-মু'মিন, আল-মুহাইমিন, আল-আজিজ, আল-জাব্বার—হে প্রভু! আপনি সবকিছুর মালিক ও পরাক্রমশালী। আপনি আমাদের পাপ ক্ষমা করুন এবং আমাদের উপর রহম করুন।

২. বিপদ ও সমস্যার সময়:

যখন কেউ বিপদে পড়ে বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়, তখন আল্লাহর এই গুণাবলির মাধ্যমে তাঁর কাছে সাহায্য চাইতে পারেন। আল্লাহর গুণাবলি উল্লেখ করে তাঁর কাছে সমস্যার সমাধান চাইলে তা দোয়ার শক্তি বাড়িয়ে দেয়।

উদাহরণ: হে আল্লাহ, আপনি আল-আজিজ, আপনি সর্বশক্তিমান। আপনি আমাদের এই বিপদ থেকে মুক্তি দিন। আপনি আল-মু'মিন, আমাদের নিরাপত্তা দিন এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা করুন।

৩. রোগমুক্তি ও আরোগ্যের জন্য:

রোগমুক্তির জন্য আল্লাহর গুণাবলি উল্লেখ করে এই আয়াতগুলো পাঠ করা দোয়ার শক্তি বাড়ায়। বিশেষত, আল্লাহর করুণা ও দয়া চেয়ে দোয়া করলে রোগমুক্তি সহজ হয়।

উদাহরণ: আল-খালিক, আল-বারি, আল-মুসাওয়ার! আপনি আমাদের সৃষ্টিকর্তা। হে আল্লাহ, আমাদের দেহে যে রোগ আছে তা দূর করে দিন এবং আমাদের সুস্থতা দান করুন।

৪. গুনাহ মাফের জন্য:

গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করতে চাইলে আল্লাহর গুণাবলি উল্লেখ করে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাওয়া যেতে পারে।

উদাহরণ: আল-কুদ্দুস, আপনি পবিত্র ও মহিমান্বিত। হে দয়াময়, আমাদের গুনাহ মাফ করুন এবং আপনার করুণা আমাদের উপর বর্ষণ করুন।

৫. জীবনের সফলতা ও কল্যাণের জন্য:

জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতা ও কল্যাণ কামনা করে আল্লাহর কাছে দোয়া করা যায় এই আয়াতগুলো পাঠ করে।

উদাহরণ: আল-মালিক, আপনি সমস্ত কিছুর মালিক। হে প্রভু, আমাদের জীবনে বরকত দিন এবং দুনিয়া ও আখিরাতে আমাদের সফল করুন।

কখন ও কীভাবে তিলাওয়াত করবেন

কখন তিলাওয়াত করবেন:

সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত তিলাওয়াত করার নির্দিষ্ট কোনো সময় না থাকলেও, হাদিসে কিছু বিশেষ সময়ে তিলাওয়াতের গুরুত্ব আলোকপাত করা হয়েছে। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সময় উল্লেখ করা হলো:

প্রতিদিন সকালে ও রাতে: হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি সকালে এবং রাতে এই তিন আয়াত তিলাওয়াত করে, আল্লাহ তাকে সারা দিন ও রাতের জন্য নিরাপত্তা প্রদান করেন।
ফজর ও মাগরিবের পর: প্রতিটি ফরজ নামাজের পর বিশেষত ফজর ও মাগরিবের পর এই আয়াতগুলো তিলাওয়াত করলে আল্লাহর বিশেষ রহমত লাভ হয়।
রাতে শোবার আগে: ঘুমানোর আগে তিলাওয়াত করলে রাতভর আল্লাহর হেফাজতে থাকা যায় এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
বিপদ বা দুশ্চিন্তার সময়: যখন কোনো বিপদ বা মানসিক অশান্তি আসে, তখন এই আয়াতগুলো তিলাওয়াত করলে আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যায়।
রোগমুক্তির জন্য: রোগী বা অসুস্থ ব্যক্তির জন্য এই আয়াতগুলো তিলাওয়াত করে আল্লাহর কাছে আরোগ্য প্রার্থনা করা যায়।

কীভাবে তিলাওয়াত করবেন:

পবিত্রতা রক্ষা: তিলাওয়াতের আগে অবশ্যই অজু করতে হবে এবং পোশাক ও স্থান পবিত্র রাখতে হবে।
মনোযোগ ও বিনম্রতা: মনোযোগ ও বিনম্রতার সঙ্গে আল্লাহর গুণাবলি ও মহিমা উপলব্ধি করে তিলাওয়াত করা উচিত।
অর্থ বুঝে পড়া: তিলাওয়াত করার সময় আয়াতগুলোর অর্থ বোঝার চেষ্টা করলে হৃদয়ে গভীর প্রভাব পড়ে এবং ইবাদতের অনুভূতি আরও তীব্র হয়।
অন্যদের সাথে শেয়ার: পরিবারের সদস্যদের বা বন্ধুদের সঙ্গে একত্রে তিলাওয়াত করলে আল্লাহর বরকত বৃদ্ধি পায়।
দোয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত: তিলাওয়াত শেষে আল্লাহর গুণাবলি উল্লেখ করে প্রয়োজনমতো দোয়া করা যেতে পারে।

আরো পড়ুনঃ মহিলাদের পর্দার নিয়ম

শেষকথাঃ উপসংহার

সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত মুসলিম জীবনে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, ভক্তি এবং আত্মার প্রশান্তি আনার অন্যতম মাধ্যম। এই আয়াতগুলোতে আল্লাহর গুণাবলি, শক্তি এবং ক্ষমতা তুলে ধরা হয়েছে, যা তিলাওয়াতকারীকে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সহায়তা করে। প্রতিদিন সকালে ও রাতে তিলাওয়াত করলে আল্লাহর বিশেষ রহমত ও সুরক্ষা লাভ করা যায়। তিলাওয়াতের পাশাপাশি আয়াতগুলোর অর্থ অনুধাবন করলে দোয়া কবুলের সম্ভাবনা বাড়ে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বরকত লাভ হয়। তাই, প্রতিটি মুসলিমের উচিত এই ফজিলতপূর্ণ আয়াতগুলো নিয়মিত তিলাওয়াত করে আল্লাহর রহমত ও কল্যাণ অর্জনের চেষ্টা করা।