টমেটো চাষের সঠিক পদ্ধতি।

 ভূমিকা 

টমেটো চাষ বাংলাদেশের অন্যতম লাভজনক ও জনপ্রিয় কৃষিকাজ। সঠিক পদ্ধতিতে টমেটো চাষ করলে কৃষকরা উচ্চ ফলন এবং ভালো অর্থনৈতিক লাভ পেতে পারেন। টমেটো চাষের সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা প্রয়োজন, বিশেষ করে জমি প্রস্তুতি, বীজ বপন, সার প্রয়োগ, সেচ, পরিচর্যা এবং রোগ নিয়ন্ত্রনের বিষয়গুলো।

এই নিবন্ধে টমেটো চাষের অদ্যোপান্ত তুলে ধরা হয়েছে, যা নতুন এবং অভিজ্ঞ উভয় ধরনের কৃষকদের জন্য সহায়ক হবে। 

আরো পড়ুনঃ লাল শাক চাষের সহজ উপায়। শীতকালীন সবজি চাষ।  

জমি নির্বাচন ও প্রস্তুতি 

টমেটো চাষের জন্য সঠিক জমি নির্বাচন এবং যথাযথ প্রস্তুতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টমেটো গাছ ভালোভাবে বেড়ে উঠতে এবং উচ্চ ফলন পেতে  উপযোগী পরিবেশ প্রয়োজন। সঠিক জমি নির্বাচন ও প্রস্তুতির মাধ্যমে গাছের পুষ্টি, মাটির আর্দ্রতা এবং বাতাস চলাচল নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। 

জমি নির্বাচনঃ 

• উর্বর মাটিঃ টমেটো চাষের জন্য দোআঁশ এবং বেলে দোআঁশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী, কারণ এই মাটিগুলোতে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো থাকে। 
• উচ্চ স্থানের জমিঃ পানি জমে না এমন উঁচু জমি টমেটো চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। এতে করে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি সহজে জমি থেকে বের হয়ে যায়। 
• pH মানঃ মাটির pH ৫.৫ থেকে ৬.৮ হওয়া উচিত। যদি মাটি অতিরিক্ত অম্লীয় বা ক্ষারীয় হয়, তবে সেটি টমেটো গাছের বৃদ্ধির জন্য  উপযোগী হবে না। মাটির pH সমন্বয় করতে প্রয়োজনীয় সার বা রাসায়নিক প্রয়োগ করা যেতে পারে। 

জমি প্রস্তুতিঃ 

• জমি চাষঃ প্রথমে জমিতে গভীর চাষ দিতে হবে। এটি মাটি ঝুরঝুরে করে এবং বাতাস চলাচল করতে সাহায্য করে। 
• জৈব সার মেশানোঃ জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব সার যেমন গোবর, কম্পস্ট, কেঁচো সার প্রয়োগ করতে হবে। এটি মাটির পুষ্টি বাড়িয়ে গাছের স্বাস্থ্যকে উন্নত করে। 
• আগাছা দমনঃ জমি প্রস্তুতের সময় আগাছা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। আগাছা গাছের পুষ্টি শোষণ করে ফেলে এবং টমেটো গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত করে। 
• মাটি সমান করাঃ জমির মাটি সমান করতে হবে যাতে টমেটো গাছগুলো সমানভাবে আলো, বাতাস এবং পানি পায়। মাটি সমান না হলে এক জায়গায় পানি জমে গাছের শিকড় পচে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। 

জমিতে সার প্রয়োগের সময়ঃ 

জমি তৈরির সময় প্রথমে জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। এতে মাটির উর্বরতা বাড়ে। এরপর প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সার যেমন ইউরিয়া, টিএসপি, এবং এমওপি মিশিয়ে দিতে হবে। তবে, সারের পরিমাণ গাছের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করা উচিত। 

সঠিকভাবে জমি নির্বাচন ও পুস্তুতির মাধ্যমে টমেটো চাষের জন্য একটি উপযুক্ত ভিত্তি তৈরি করা সম্ভব, যা পরবর্তী ধাপে গাছের সঠিক বৃদ্ধি ও উচ্চ ফলনের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে। 

টমেটো বীজ বপন 

টমেটো চাষের প্রথম ধাপ হলো সঠিক পদ্ধতিতে বীজ বপন করা। উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ নির্বাচন এবং সঠিক সময়ে বীজ বপন করলে টমেটো গাছের গুণগত মান ভালো হয় এবং ফোলনও বৃদ্ধি পায়। টমেটো চাষের জন্য গ্রীষ্মকালীন এবং শীতকালীন উভয় ধরনের জাতের বীজ পাওয়া যায়, যা নির্দিষ্ট সময়ে বপন করা দরকার। 

বীজ নির্বাচনঃ 

• উচ্চ ফলনশীল এবং রোগ প্রতিরোধী জাতের বীজ নির্বাচন করা উচিত, যা স্থানীয় জলবায়ুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। 
• কিছু জনপ্রিয় জাত যেমন হাইব্রিড, দেশি বা সিলেক্টেড বীজ নির্বাচন করা যেতে পারে। 
• রোগমুক্ত বীজ নিশ্চিত করতে ভালো মানের কোম্পানির বীজ কেনা উচিৎ। এতে গাছের রোগ-বালাইয়ের ঝুঁকি কমে যায়। 

বপন সময়ঃ 

• শীতকালীন চাষঃ সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে বীজ বপন করতে হবে। 
• গ্রীষ্মকালীন চাষঃ ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সময়টিতে বীজ বপন করা যায়। 
• সঠিক মৌসুমে বীজ বপন করলে গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ফলন ভালো হয়। 

বীজতলা প্রস্তুতিঃ 

• মাটি প্রস্তুতিঃ বীজতলার মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে এবং ভালোভাবে সার মিশিয়ে উর্বরতা বৃদ্ধি করতে হবে। বীজতলার মাটিতে পচা গোবর বা কেঁচো সার মিশিয়ে নিলে এটি দ্রুত বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটায়। 
• বীজ বপন পদ্ধতিঃ টমেটোর বীজ বপন করার জন্য প্রায় ০.৫ সেন্টিমিটার গভীর গর্ত তৈরি করে তাতে বীজ রাখতে হবে। এরপর মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে যাতে সূর্যের আলো সরাসরি বীজের উপর না পড়ে। 
• জমিতে রোপণের জন্য চারার প্রস্তুতিঃ বীজ বপনের প্রায় ২০-২৫ দিনের মধ্যে চারা তৈরি হয়ে যায়। চারা যখন ৫-৭ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে যায় এবং গাছে ৪-৫টি পাতা গজায়, তখন সেগুলো জমিতে রোপণের উপযুক্ত হয়। 

চারা রোপণের জন্য প্রস্তুতিঃ 

• বীজতলায় বপন করার পর প্রতিদিন সকালে এবং বিকেলে চারা গাছে পানি দিতে হবে, যাতে মাটি স্যাঁতসেঁতে থাকে এবং চারা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। 
• চারার শিকড় মজবুত হওয়ার জন্য বীজতলা থেকে দুর্বল চারা তুলে ফেলা উচিত। এতে শক্তিশালী চারা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং পরে জমিতে রোপণ করা সহজ হয়। 

সঠিকভাবে বীজ নির্বাচন, সময় মতো বীজ বপন, এবং যত্ন সহকারে চারা তৈরি করে জমিতে রোপণ করার মাধ্যমে টমেটো চাষের শক্ত ভিত্তি তৈরি হয়, যা পরে গাছের উৎপাদনশীলতাকে অনেকাংশ প্রভাবিত করে। 

চারা রোপণ 

টমেটো চাষে সফলতা পাওয়ার জন্য বীজতলা থেকে চারা উঠিয়ে সঠিকভাবে জমিতে রোপণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক সময়ে, সঠিক দূরত্বে এবং যত্ন সহকারে চারা রোপণ করলে টমেটো গাছের বৃদ্ধি ভালো হয় এবং ফলন বৃদ্ধি পায়। চারা রোপণের সময় বেশ কয়েকটি বিষয়ে নজর রাখা প্রয়োজন। 

রোপণের উপযুক্ত সময়ঃ 

• সাধারণত চারা রোপণের জন্য গাছের উচ্চতা ৫-৭ সেন্টিমিটার হলে এবং এতে ৪-৫টি পাতা গজালে, চারা রোপণের উপযুক্ত সময় হিসেবে ধরা হয়। 
• শীতকালীন চাষে অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে চারা রোপণ করা ভালো, এবং গ্রীষ্মকালীন চাষে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসে রোপণ করা যেতে পারে। 

দূরত্ব ও সারি বিন্যাসঃ 

• গাছের মধ্যে দূরত্বঃ প্রতিটি গাছের মধ্যে প্রায় ৫০ সেন্টিমিটার দূরত্ব রাখা প্রয়োজন। এতে গাছগুলোর শিকড় পর্যাপ্ত জায়গা পায় এবং গাছের বৃদ্ধি ঠিক থাকে। 
• সারির মধ্যে দূরত্বঃ প্রতিটি সারির মধ্যে ৭৫ সেন্টিমিটার দূরত্ব রাখতে হবে, যাতে রৌদ্রের আলো সব গাছে সঠিকভাবে পৌঁছাতে পারে এবং বাতাস চলাচল করে। 
• এই দূরত্ব বজায় রাখলে গাছের শাখা-প্রশাখা সঠিকভাবে বিকাশ লাভ করে এবং ফসল সংগ্রহ করাও সহজ হয়। 

রোপণের পদ্ধতিঃ 

• গর্ত তৈরিঃ প্রতিটি চারা রোপণের জন্য প্রায় ১০ সেন্টিমিটার গভীর গর্ত তৈরি করেতে হবে। 
• চারার শিকড়ের যত্নঃ বীজতলা থেকে চারা উঠানোর সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন শিকড়ের কোনো ক্ষতি না হয়। শিকড় মাটি সহ তুলে নিলে চারা দ্রুত জমির মাটির সাথে মানিয়ে নিতে পারে। 
• রোপণের প্রক্রিয়াঃ চারার শিকড় মাটির সাথে সমনভাবে বসিয়ে, মাটি দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিতে হবে। এরপর চারার চারপাশের মাটি হাত দিয়ে চেপে দৃঢ করতে হবে, যাতে চারাটি মাটির সাথে ভালোভাবে আটকে যায়। 

প্রথম সেচ প্রদানঃ 

• চারা রোপণের পরপরই প্রথম সেচ দিতে হবে। প্রথম সেচের মাধ্যমে মাটি ও শিকড়ের মধ্যে ভালোভাবে সংযোগ তৈরি হয় এবং চারা দ্রুত মাটির সাথে মানিয়ে নিতে পারে। 
• এরপর গাছের প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দিতে হবে, তবে অতিরিক্ত পানি দেওয়া ঠিক নয়, কারণ এতে শিকড় পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 

পরিচর্যার প্রয়োজনীয়তাঃ 

• চারা রোপণের পর প্রথম কয়েক সপ্তাহ গাছের বিশেষ পরিচর্যা প্রয়োজন। প্রথম দিকে নিয়মিত মাটির আর্দ্রতা ঠিক রাখতে সেচ দিতে হবে। '
• গাছের চারপাশে আগাছা জন্মালে তা তুলে ফেলতে হবে, কারণ আগাছা গাছের পুষ্টি শোষণ করে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত করে। 

সঠিকভাবে চারা রোপণ করলে টমেটো গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং গাছের শাখা-প্রশাখা সুগঠিত হয়। এছাড়াও, সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ করলে গাছের শিকড় ও শাখা-প্রশাখা পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টি ও আলো পায়, যা পরবর্তীতে ফলন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। 

সার প্রয়োগ 

টমেটো গাছের সঠিক বৃদ্ধির জন্য এবং উচ্চ ফলন নিশ্চিত করতে সঠিক মাত্রায় এবং সঠিক সময়ে সার প্রয়োগ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টমেটো গাছের জন্য বিভিন্ন ধরনের সার যেমন জৈব সার এবং রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়। সার প্রয়োগের সঠিক পদ্ধতি গাছের শিকড়, পাতা এবং ফলের বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। 

জৈব সার প্রয়োগঃ 

• গোবর সারঃ জমি প্রস্তুতির সময় গোবর সার প্রয়োগ করা উচিত। এটি মাটির উর্বরতা বাড়ায় এবং গাছের পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত করে। 
• কম্পোস্ট সারঃ জমিতে কম্পোস্ট সার মেশালে মাটির জীবাণু সক্রিয় থাকে এবং গাছ সহজে পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে। 
• কেঁচো সারঃ কেঁচো সার মাটিতে মিশ্রিত করলে মাটির বায়ুর চলাচল বৃদ্ধি পায়, যা গাছের শিকড়ের বৃদ্ধির জন্য উপকারী। 

রাসায়নিক সার প্রয়োগঃ 

• প্রথম পর্যায়ঃ জমি প্রস্তুতির সময় প্রাথমিকভাবে জৈব সার মাটির সাথে মিশিয়ে নিতে হবে। এরপর প্রয়োজনমতো রাসায়নিক সার যেমন ইউরিয়া, টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) এবং এমওপি (মিউরিয়েট অব পটাশ) সঠিক পরিমাণে প্রয়োগ করতে হবে। 
• দ্বিতীয় পর্যায়ঃ চারা রোপণের ২০-২৫ দিন পর গাছের আবারও ইউরিয়া এবং টিএসপি প্রয়োগ করা যেতে পারে।  
• তৃতীয় পর্যায়ঃ ফল আসার সময় গাছের আরও পুষ্টি প্রয়োজন হয়। এই সময়ে গাছে পুনরায় ইউরিয়া এবং পটাশ প্রয়োগ করা যেতে পারে। এটি ফলের গুণগত মান উন্নত করতে সাহায্য করে। 

সারের পরিমাণ নির্ধারণঃ 

• প্রতি বিঘা জমির জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে, যা মাটির উর্বরতার উপর নির্ভর করে। সাধারণত এক বিঘা জমির জন্য ইউরিয়া ৪০-৫০ কেজি, টিএসপি ৩৫-৪০ কেজি এবং পটাশ ২৫-৩০ কেজি প্রয়োগ করা হয়। 
• তবে, সারের সঠিক পরিমাণ নির্ধারণের জন্য স্থানীয় কৃষি অফিস থেকে পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। 

সার প্রয়োগের পদ্ধতিঃ 

• রাসায়নিক সার প্রয়োগের সময় গাছের গোঁড়া থেকে সামান্য দূরে মাটি খুঁড়ে সার মিশিয়ে দিতে হবে, যাতে শিকর সরাসরি সার স্পর্শ না করে। 
• সারের প্রয়োগের পর গাছের গোঁড়ায় সামান্য মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দিতে হবে। এতে সার মাটিতে দ্রবিভুত হয়ে গাছের শিকড় সহজে পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে। 

সার প্রয়োগের সতর্কতাঃ 

• অতিরিক্ত সার প্রয়োগ করলে গাছের শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। 
• রাসায়নিক সার প্রয়োগের পর পরই বেশি পানি না দেওয়া উচিত, কারণ এতে সারের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে। 

সঠিকভাবে এবং পরিমাণমতো সার প্রয়োগ করলে টমেটো গাছ সুস্থ ও সবলভাবে বেড়ে ওঠে এবং উচ্চ মানের ফলন পাওয়া যায়। সারের সঠিক প্রয়োগ গাছের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করে, যা কৃষকদের জন্য লাভজনক ফসল উৎপাদনে সহায়ক হয়। 

সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা 

টমেটো গাছের বৃদ্ধি ও ফলনের জন্য সঠিক সময়ে সেচ দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত কিংবা কম সেচ, উভয় ক্ষেত্রেই গাছের উপর বিরূপ প্রভাব পরে। সেচের মাধ্যমে মাটির আর্দ্রতা ঠিক রাখা গেলে গাছ সঠিকভাবে পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে,ফলে ফলন ও গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। 

সেচের সময় ও পর্যায়ঃ 

• চারা রোপণের পরপরই প্রথম সেচঃ চারা রোপণের পর প্রথম সেচ দিতে হবে, যাতে গাছের শিকড় দ্রুত মাটির সাথে মিশে যায় এবং সহজে মাটি থেকে পুষ্টি শোষণ করতে পারে। 
• প্রতি সপ্তাহে সেচঃ টমেটো গাছের বৃদ্ধির জন্য প্রতি সপ্তাহে ১-২ বার সেচ প্রয়োজন হয়। তবে, সেচের পরিমাণ ও সময় স্থানীয় আবহাওয়া এবং মাটির আর্দ্রতার উপর নির্ভর করে। 
• ফল ধরার সময়ঃ টমেটো গাছে যখন ফুল ও ফল আসা শুরু হয়, তখন গাছের বেশি পানি প্রয়োজন হয়। এই সময়ে নিয়মিত সেচ দেওয়া উচিত যাতে ফলের আকার ও গুণগত মান ঠিক থাকে। 

সেচের পদ্ধতিঃ 

• ফুরো সেচ পদ্ধতিঃ ফুরো সেচ পদ্ধতিতে গাছের দুই সারির মাঝে মাটিতে গভীর ফুরো তৈরি করে সেখানে সেচ দেওয়া হয়। এতে গাছের শিকড় পর্যাপ্ত পানি পায়, কিন্তু গাছের গোঁড়ায় অতিরিক্ত পানি জমে না। 
• ড্রিপ সেচ পদ্ধতিঃ ড্রিপ সেচ পদ্ধতিতে প্রতিটি গাছের গোঁড়ায় নির্দিষ্ট পরিমাণে পানি পৌঁছানো হয়, যা পানি অপচয় কমায় এবং মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখে। 

পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাঃ 

• উঁচু জমিতে চাষঃ টমেটো চাষের জন্য উঁচু জমি নির্বাচন করা উচিত, যাতে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি জমিতে জমে না থাকে এবং সহজেই নিষ্কাশিত হয়। 
• ফুরো তৈরিঃ জমিতে ফুরো তৈরি করে সেচ দেওয়ার ফলে পানি সহজেই নিষ্কাশিত হয় এবং গাছের গোঁড়ায় পানি জমে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়, যা শিকড়ের পচন থেকে রক্ষা করে। 

অতিরিক্ত সেচের প্রভাবঃ 

• অতিরিক্ত সেচ দিলে গাছের শিকড় পচে যেতে পারে এবং গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। 
• সেচের মাধ্যমে মাটিতে থাকা অতিরিক্ত সার ধুয়ে যেতে পারে, যা গাছের পুষ্টি গ্রহণের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। 

সেচের সময় সতর্কতাঃ 

• প্রচণ্ড রোদে সেচ না দেওয়া ভালো, কারণ এতে গাছের পাতা ঝলসে যেতে পারে। সকালে বা বিকেলে সেচ দেওয়া উত্তম। 
• টমেটো গাছের ফুল ফোটার সময় অতিরিক্ত সেচ দিলে ফুল ঝরে যেতে পারে, যা ফলনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। 

সঠিক সময়ে ও সঠিক পদ্ধতিতে সেচ দিলে টমেটো গাছের শিকড় মাটি থেকে সহজেই পুষ্টি শোষণ করতে পারে এবং গাছ সুস্থ ও সবলভাবে বেড়ে ওঠে। সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনার সঠিক নিয়ম মেনে চললে টমেটোর ফলন বৃদ্ধি পায়, যা কৃষকের জন্য অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়। 

রোগ ও পোকামাকড় দমন 

টমেটো গাছের ফলন ও গুণগত মান বজায় রাখতে রোগ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টমেটো গাছ বিভিন্ন ধরনের রোগ এবং পোকামাকড়ের আক্রমণের শিকার হয়, যা গাছের বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে এবং ফলের মান কমিয়ে দেয়। সঠিক সময়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং যত্নশীল মনোযোগের মাধ্যমে এসব সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। 

টমেটোর সাধারণ রোগঃ 

• ব্লাইট রোগঃ ব্লাইট একটি ছত্রাকজনিত রোগ, যা গাছের পাতা, কান্ড এবং ফলে কালো দাগ তৈরি করে। 
• প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণঃ রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করা এবং আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে রাখা। প্রয়োজনে ছত্রাকনাশক স্প্রে করা যেতে পারে। 
• মোজাইক ভাইরাসঃ এই রোগে গাছের পাতা হলুদ এবং সবুজ দাগযুক্ত মোজাইক আকৃতির হয়, ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। 
• প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণঃ রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার এবং আক্রান্ত গাছ অপসারণ করা। মোজাইক ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে নির্দিষ্ট কীটনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে। 
  

টমেটো গাছের সাধারণ পোকামাকড়ঃ 

• ফল ছিদ্রকারী পোকারাঃ এই পোকারা টমেটো গাছের ফলের মধ্যে ঢুকে পরে এবং ফল নষ্ট করে। 
• প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণঃ নিয়মিত গাছের পরিচর্যা, আক্রান্ত ফল অপসারণ এবং কীটনাশক প্রয়োগ।
• সাদা মাছিঃ সাদা মাছি পাতার রস শোষণ করে, ফলে গাছ দুর্বল হয়ে পরে। 
• প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণঃ কীটনাশক স্প্রে এবং প্রতিরোধক ফাঁদ ব্যবহার করে সাদা মাছি দমন। 

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাঃ 

• বালাইমুক্ত বীজঃ রোগমুক্ত এবং সার্টিফাইড বীজ ব্যবহার করা ভালো। 
• আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণঃ মাটির আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং অতিরিক্ত পানি জমতে না দেওয়া।
• পোকামাকড় প্রতিরোধী জাত নির্বাচনঃ টমেটোর এমন জাত নির্বাচন করা যা বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী। 

সঠিক রোগ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে টমেটো গাছকে রোগমুক্ত রাখা সম্ভব এবং ফলনের গুণগত মান বৃদ্ধি করা যায়। নিয়মিত পরিচর্যা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে টমেটো চাষে সফলতা পাওয়া সহজ হয়, যা কৃষকদের জন্য লাভজনক ও নিরাপদ চাষাবাদ নিশ্চিত করে। 

ফসল সংগ্রহ ও পরবর্তী যত্ন 

টমেটো ফসল সংগ্রহের সঠিক সময় এবং সঠিক পদ্ধতি মেনে চললে গুণগত মান বজায় থাকে এবং ফসলের সংরক্ষণ সহজ হয়। টমেটো সাধারণত ফল পরিপক্ক হওয়ার পরে এবং ফলের রঙ পরিবর্তিত হলে সংগ্রহ করা হয়। ফসল সংগ্রহের পরে সঠিক পদ্ধতিতে যত্ন নেওয়া হলে দীর্ঘ সময় ধরে টমেটো সংরক্ষণ করা যায় এবং বাজারজাতকরণের সময় ফলের মান ভালো থাকে। 

ফসল সংগ্রহের সঠিক সময়ঃ 

• টমেটো সাধারণত ফুল আসার ৬০-৮০ দিনের মধ্যে পাকার উপযুক্ত হয়। 
• যখন ফলের রঙ সম্পূর্ণ লাল বা হলুদ হয়ে যায়, তখন এটি সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। 
• বাজারজাত করার উদ্দেশ্যে যদি কিছুটা কমপাকা ফল দরকার হয়, তবে হালকা লাল বা কমলা রঙ হলে সংগ্রহ করা যেতে পারে। 

ফসল সংগ্রহের পদ্ধতিঃ 

• সাবধানে সংগ্রহঃ টমেটো ফল গাছ থেকে সাবধানে হাত দিয়ে পেঁচিয়ে সংগ্রহ করতে হবে, যাতে গাছ বা শাখা ভেঙে না যায়। 
• সঠিক সরঞ্জাম ব্যবহারঃ ফল কাটার জন্য ক্ষুর, কাঁচি বা অন্যান্য ছোট কাটার ব্যবহার করা যেতে পারে, যাতে ফলের গায়ে কোনো ক্ষতি না হয়। 
• ফল সংগ্রহের সময়ঃ সাধারণত সকালের দিকে ফসল সংগ্রহ করা ভালো, কারণ এই সময়ে ফলের আর্দ্রতা কম থাকে, যা সংরক্ষনে সহায়ক। 

সংরক্ষণ পদ্ধতিঃ 

• ঠাণ্ডা এবং শুষ্ক স্থানে রাখাঃ টমেটো ফসলের গুণগত মান বজায় রাখতে ঠাণ্ডা এবং শুষ্ক স্থানে রাখা উচিত। 
• জাল বা ঝুরিতে রাখাঃ সংগ্রহের পর টমেটো ফলকে জাল বা খোলামেলা ঝুড়িতে রাখা উচিত, যাতে ফলগুলো বাতাস পায় এবং সংরক্ষনে দীর্ঘস্থায়ী হয়। 
• হিমায়িত সংরক্ষণঃ দীর্ঘ সময় সংরক্ষণের জন্য টমেটোকে ঠাণ্ডা স্থানে বা ফ্রিজে রাখা যেতে পারে। 

প্যাকেজিং ও বাজারজাতকরণঃ 

• প্লাস্টিক বা কাঠের বাক্সে রাখাঃ টমেটো ফসল পরিবহণের জন্য প্লাস্টিক বা কাঠের বাক্স ব্যবহার করা যেতে পারে, যা ফলের গুণগত মান অক্ষুণ্ণ রাখে। 
• সঠিক পরিবহন ব্যবস্থাঃ বাজারজাতকরণের সময় যত্নসহকারে পরিবহন করতে হবে, যাতে ফলের গায়ে কোনো আঘাত না লাগে। 

টমেটো ফসলের গুণগত মান বজায় রাখতে সঠিক এবং সাবধানে ফসল সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং বাজারজাতকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক পরিচর্যা এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে টমেটো ফসল সংরক্ষণ করা যায় এবং কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের জন্য ভালো মুল্য পেতে পারেন। 

শেষকথাঃ উপসংহার 

টমেটো চাষ একটি লাভজনক কৃষি উদ্যোগ, যা বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে টমেটো চাষ করলে উচ্চ ফলন নিশ্চিত করা সম্ভব এবং বাজারে এর চাহিদা থাকার কারণে এটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনকও বটে। টমেটো চাষের প্রতিটি ধাপে, যেমন বীজ নির্বাচন, জমি প্রস্তুতি, সঠিক সার প্রয়োগ, সেচ ব্যবস্থা, এবং রোগ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ, যথাযথভাবে মনোযোগ দেওয়া উচিত।

সঠিক সময়ে ফসল সংগ্রহ এবং জমির পরিচ্ছনতা বজায় রেখে চাষাবাদ করলে পরবর্তী মৌসুমের জন্য জমিকে আরও উর্বর রাখা যায়। এসব প্রক্রিয়া কৃষকদের টমেটো চাষে সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে সহায়ক। সুতরাং, আধুনিক পদ্ধতি এবং সঠিক যত্নের মাধ্যমে টমেটো চাষে উচ্চ মানের ফলন এবং আয় নিশ্চিত করা সম্ভব, যা কৃষকের জীবনমান উন্নত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।