খুসখুসে কাশি দূর করার ১২টি উপায়। কাশি কমানোর কার্যকরী উপাদান

শীতকালে ঠোঁট ও ত্বক ফেটে যাওয়ার কারণ এবং এর কার্যকর প্রতিকার খুসখুসে কাশি দূর করার জন্য আমরা অনেকেই অনেক কিছু করে থাকি। খুসখুসে কাশি এক ধরনের অস্বস্তিকর এবং দীর্ঘস্থায়ী কাশি যা সাধারণত শ্বাসনালীতে শ্লেষ্মা জমে যাওয়ার ফলে হয়। সাধারণত এটি ঠাণ্ডা, সর্দি, অ্যালার্জি, বা শ্বাসনালী সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে।

খুসখুসে কাশি বেশ সময় ধরে চলতে থাকলে তা খুবই বিরক্তিকর হতে পারে এবং সাধারণত এটি খুবই অস্বস্তিকর। তবে কিছু প্রাকৃতিক উপায় রয়েছে যা খুসখুসে কাশি দ্রুত উপশম করতে সাহায্য করে। এই উপায়গুলো গলার শ্লেষ্মা দূর করে, শ্বাসনালীকে পরিষ্কার রাখে এবং কাশি কমাতে সহায়তা করে। এখানে খুসখুসে কাশি দূর করার কিছু বিস্তারিত ও কার্যকরী প্রাকৃতিক উপায় আলোচনা করা হলোঃ 

১। মধু এবং আদাঃ 

মধু এবং আদা দুটি খুবই শক্তিশালী প্রাকৃতিক উপাদান যা কাশি কমাতে সহায়তা করে। আদা গলার শ্বাসনালীকে পরিষ্কার করে এবং শরীরের জমে থাকা শ্লেষ্মা বের করে দেয়। অপরদিকে, মধু গলার শুষ্কতা এবং জ্বালা কমাতে সাহায্য করে এবং এটি একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান যা কাশির উপশমে কার্যকরী। 

কীভাবে ব্যবহার করবেনঃ 

• এক কাপ গরম পানিতে কিছু টুকরা আদা এবং এক কাপ চামচ মিধু মিশিয়ে পান করুন। 
• এটি দিনে ২-৩ বার পান করা যেতে পারে, বিশেষত সকালে এবং রাতে। 
• আদা ও মধুর মিশ্রণটি গলা এবং শ্বাসনালীকে শান্ত রাখে, ফলে কাশি কমাতে সাহায্য করে। 

কেন কার্যকরঃ 

আদা অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি গুণে ভরপুর এবং মধু গলা শীতল করে ও কাশি দূর করে। এই দুই উপাদান একত্রে শরীরকে দ্রুত সুস্থ করতে সাহায্য করে এবং কাশি উপশমে সাহায্য করে। 

২। গরম পানির ভাপঃ 

গরম পানির ভাপ শ্বাসনালী এবং গলার প্রদাহ কমানোর একটি চমৎকার উপায়। যখন আপনি গরম পানির ভাপ নেন, এটি শ্বাসনালীকে আর্দ্র রাখে এবং শ্লেষ্মা দ্রবীভূত করতে সহায়তা করে, যা কাশির উপশমে সহায়ক। গরম পানির ভাপ শ্বাসনালীকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে এবং গলা শীতল করে, ফলে কাশি কমে। 

কীভাবে ব্যবহার করবেনঃ 

• একটি বাটি গরম পানি নিয়ে, তার উপরে একটি তোয়ালে দিয়ে মাথা ঢেকে শ্বাস নিন। 
• শ্বাস গভীরভাবে নিন এবং এটি ৫-১০ মিনিট করুন। 
• চাইলে, গরম পানিতে কিছু আদা, তেজপাতা বা লবঙ্গ যোগ করতে পারেন, যা কাশির উপশমে আরও কার্যকরী। 

যেন কার্যকরঃ 

গরম পানি শ্বাসনালীকে আর্দ্র রাখে, শ্লেষ্মা দূর করতে সাহায্য করে এবং কাশি কমাতে সহায়তা করে। এটি গলার প্রদাহও কমায়, যা কাশির অন্যতম কারণ হতে পারে।

আরো পড়ুনঃ  মাথার খুশকিঃ খুশকি থেকে মুক্তি পাওয়ার ঘরোয়া সমাধান 

৩। তেজপাতা এবং মেথিঃ 

তেজপাতা এবং মেথি একত্রে কাশি কমানোর একটি অত্যন্ত কার্যকরী উপায়। তেজপাতা অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণে ভরপুর, যা শ্বাসনালীকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং গলার প্রদাহ কমায়। মেথি গলার শ্লেষ্মা পরিষ্কার রাখতে সহায়তা করে এবং শ্বাসনালীকে সুরক্ষা দেয়। 

কীভাবে ব্যবহার করবেনঃ 

• কিছু তেজপাতা এবং মেথি পানিতে ফুটিয়ে নিন। 
• এই মিশ্রণটি গরম উবস্থায় পান করুন এবং শ্বাস নিন। 
• দিনে ২-৩ বার এটি পান করা যেতে পারে। 

কেন কার্যকরঃ 

তেজপাতা গলার প্রদাহ কমায় এবং মেথি শ্বাসনালীকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এটি কাশি কমানোর একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক উপায়। 

৪। লবণ পানি দিয়ে গার্গলঃ 

গলা পরিষ্কার রাখার জন্য লবণ পানি দিয়ে গার্গল একটি সহজ এবং কার্যকরী পদ্ধতি। এটি গলার শ্লেষ্মা পরিষ্কার করে, প্রদাহ কমায় এবং ব্যাকটেরিয়া দূর করে। লবণ পানি গলা থেকে শ্লেষ্মা ও ব্যাকটেরিয়া পরিষ্কার করে, ফলে কাশি কমে। 

কীভাবে ব্যবহার করবেনঃ 

• এক কাপ গরম পানিতে এক চামচ লবণ মিশিয়ে গার্গল করুন। 
• দিনে ২-৩ বার এটি গার্গল করুন। 

কেন কার্যকরঃ 

লবণ পানি গলার প্রদাহ কমায়, শ্লেষ্মা পরিষ্কার করে এবং কাশি কমাতে সহায়তা করে। এটি খুবই সহজ এবং প্রাকৃতিক একটি পদ্ধতি। 

৫। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবারঃ 

ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং শ্বাসনালীকে শক্তিশালী রাখে। কমলা, আমলা, লেবু, স্ট্রবেরি ইত্যাদি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল খেলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং কাশি কমাতে সহায়তা করে। 

কীভাবে ব্যবহার করবেনঃ 

• প্রতিদিন কমলা, আমলা, লেবু খাওয়া শুরু করুন। 
• টাটকা ফলের রস পান করুন, যা শরীরকে আরও শক্তিশালী রাখবে। 

কেন কার্যকরঃ 

ভিটামিন সি গলার প্রদাহ কমায়, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং কাশি কমাতে সহায়তা করে। এটি শ্বাসনালীর সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

৬। প্রচুর পানি পান করাঃ 

প্রচুর পানি পান করার অভ্যাস কাশি দূর করার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপায়। পানি শ্বাসনালীকে আর্দ্র রাখে এবং শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়। এটি গলা শীতল রাখে, শ্লেষ্মা পরিষ্কার করে এবং কাশি কমাতে সহায়তা করে।

কীভাবে ব্যবহার করবেনঃ 

• দিনে অন্তত ৮ গ্লাস পানি পান করুন। 
• গরম পানি পান করাও উপকারী হতে পারে, যা শরীরকে আর্দ্র রাখে। 

কেন কার্যকরঃ 

পানি শ্বাসনালীকে আর্দ্র রাখে, গলা শীতল করে এবং শ্লেষ্মা পরিষ্কার করতে সহায়তা করে, যা কাশি কমাতে সাহায্য করে। 

৭। হলুদের ব্যবহারঃ 

হলুদ একটি শক্তিশালী অ্যান্টি-উনফ্লামেটরি উপাদান, যা কাশি কমাতে সাহায্য করে। এটি শরীরের প্রদাহ কমায় এবং শ্বাসনালীকে পরিষ্কার রাখে। হলুদের মধ্যে রয়েছে কুরকুমিন নামক এক প্রাকৃতিক উপাদান, যা প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে এবং শ্বাসনালীতে জমে থাকা শ্লেষ্মা দূর করে। 

কীভাবে ব্যবহার করবেনঃ 

• এক কাপ গরম দুধে এক চামচ হলুদ মিশিয়ে পান করুন। 
• এটি রাতে শোয়ার আগে খাওয়ালে আরও ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। 

কেন কার্যকরঃ 

হলুদ গলার প্রদাহ কমায়, শ্বাসনালী পরিষ্কার রাখে এবং কাশি কমাতে সহায়তা করে। এটি কাশি  দূর করতে একটি কার্যকরী প্রাকৃতিক উপায়। 

৮। গরম স্যুপঃ 

গরম স্যুপ যেমন মুরগির স্যুপ বা ভেজিটেবল স্যুপ খাওয়া শ্বাসনালীকে পরিষ্কার রাখে এবং কাশি কমাতে সাহায্য করে। গরম স্যুপ গলার শ্লেষ্মা দ্রবীভূত করে এবং শ্বাসনালীকে শীতল রাখে, যা কাশি কমাতে সহায়ক। 

কীভাবে ব্যবহার করবেনঃ 

• প্রতিদিন গরম স্যুপ পান করুন, যা শ্বাসনালীকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করবে। 

কেন কার্যকরঃ 

গরম স্যুপ শ্বাসনালীকে পুরিস্কার রাখে, শ্বাসের পথে কোনো বাধা সৃষ্টি হওয়ার আগেই তা দূর করে এবং কাশি কমাতে সাহায্য করে। 

৯। পুদিনা পাতাঃ 

পুদিনা পাতা প্রাকৃতিকভাবে শ্বাসনালীকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে এবং কাশি কমাতে কার্যকরী। এটি গলার জ্বালা কমায়, শ্বাসপ্রশ্বাসকে সহজ করে এবং শ্লেষ্মা পরিষ্কার কতে সহায়তা করে। পুদিনার মধ্যে রয়েছে মেনথল, যা গলার প্রদাহ কমিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসকে স্বাভাবিক রাখে। 

কীভাবে ব্যবহার করবেনঃ 

• পুদিনা পাতা গরম পানিতে ফুটিয়ে চা তৈরি করে পান করুন। 
• পুদিনা পাতা দিয়ে গরম পানির ভাপ নেওয়া যেতে পারে, যা শ্বাসনালীকে পরিষ্কার রাখবে এবং কাশি কমাবে। 

কেন কার্যকরঃ 

পুদিনা গলার প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে, শ্বাসনালীকে পরিষ্কার রাখে এবং শ্লেষ্মা দূর করে। এটি শ্বাসপ্রশ্বাসকে সহজ করে এবং কাশি কমাতে সাহায্য করে।

আরও পড়ুনঃ শীতকালে ত্বকের যত্নের গুরুত্ব এবং উপায়ঃ শীতকালীন ত্বকের সমস্যা এবং সমাধান  

১০। বেশি বিশ্রাম নেওয়াঃ 

যখন শরীর ক্লান্ত থাকে, তখন কাশি আরও বেশি বাড়তে পারে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে এবং দ্রুত সেরে উঠতে সহায়তা করে। ঘুমের সময় শরীরকে পূর্ণ বিশ্রাম দেওয়ার মাধ্যমে শ্বাসনালী ও গলা সুস্থ থাকে এবং কাশি কমে। 

কীভাবে ব্যবহার করবেনঃ 

• রাতে ভালোভাবে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমান। 
• বিশ্রাম নিন, যাতে শরীর পুনরুজ্জীবিত হয় এবং কাশি দ্রুত কমে। 

কেন কার্যকরঃ 

বিশ্রাম শরীরের শক্তি পুনরুদ্ধার করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে। এটি কাশি কমাতে সহায়তা করে এবং দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করে। 

১১। সোডিয়াম বাইকার্বোনেটঃ 

বেকিং সোডা কাশি কমাতে সাহায্য করে, কারণ এটি গলার শ্লেষ্মা পরিষ্কার করে এবং শ্বাসনালীকে পরিষ্কার রাখে। এটি গলা থেকে জমে থাকা অতিরিক্ত  শ্লেষ্মা বের করে এবং কাশি কমাতে সহায়তা করে। 

কীভাবে ব্যবহার করবেনঃ 

• এক গ্লাস গরম পানিতে আধা চামচ বেকিং সোডা মিশিয়ে পান করুন। 
• এটি দিনে ১-২ বার খাওয়া যেতে পারে। 

কেন কার্যকরঃ 

বেকিং সোডা গলার শ্লেষ্মা পরিষ্কার করে এবং কাশি কমাতে সহায়তা করে। এটি শ্বাসনালীকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে, ফলে কাশি কমে। 

১২। লেবুর ব্যবহারঃ 

লেবু একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান, যা কাশি কমাতে সহায়তা করে। এটি গলার প্রদাহ কমায়, শ্বাসনালীকে পরিষ্কার রাখে এবং শরীরকে হাইড্রেট রাখে। লেবুর সাইট্রিক অ্যাসিড শ্লেষ্মা কমাতে সহায়তা করে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে। 

কীভাবে ব্যবহার করবেনঃ 

• এক গ্লাস গরম পানিতে এক চামচ লেবুর রস এবং মধু মিশিয়ে পান করুন। 
• এটি দিনে ২-৩ বার খাওয়া যেতে পারে। 

কেন কার্যকরঃ 

লেবু গলার প্রদাহ কমায়, শ্বাসনালীকে পরিষ্কার রাখে এবং শরীরকে হাইড্রেট রাখে, ফলে কাশি কমতে সাহায্য করে। 

আরো পড়ুনঃ পেটের সমস্যা মোকাবেলায় প্রাকৃতিক চিকিৎসা। গ্যাস, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং অ্যাসিডিটি 

শেষকথাঃ উপসংহার 

খুসখুসে কাশি দূর করার জন্য অনেক প্রাকৃতিক উপায় রয়েছে যা সহজে ঘরে তৈরি করা যায় এবং অত্যন্ত কার্যকর। মধু, আদা, গরম পানির ভাপ, লবণ পানি দিয়ে গার্গল, পুদিনা পাতা, হলুদ, এবং লেবুর মতো উপাদানগুলি খুবই কার্যকরী। এর পাশাপাশি পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া এবং বিষাক্ত পরিবেশ থেকে দূরে থাকা কাশি কমানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

যদিও এই প্রাকৃতিক উপায়গুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে কার্যকরী, তবে যদি কাশি দীর্ঘস্থায়ী হয় বা আরও খারাপ হয়, তবে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।