শীতকালে ঠোঁট ও ত্বক ফেটে যাওয়ার কারণ এবং এর কার্যকর প্রতিকার

শীতকাল মানেই এক ধরনের শুষ্কতা ও ঠাণ্ডা বাতাসের উপস্থিতি, যা আমাদের ত্বক বা ঠোঁটের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। অন্যান্য ঋতুতে আমাদের ত্বক স্বাভাবিকভাবেই আর্দ্র ও কোমল থাকে, কিন্তু শীতকালে ত্বক তার প্রাকৃতিক আর্দ্রতা হারিয়ে ফেলে এবং এর ফলে ঠোঁট ও গায়ের চামড়া শুষ্ক হয়ে ফেটে যায়। 

বহিরাগত ঠাণ্ডা আবহাওয়া এবং ঘরের ভেতরের শুষ্ক পরিবেশ একসঙ্গে ত্বকের আর্দ্রতাকে কমিয়ে দেয়, যা ফাটার প্রধান কারণ। এর সঙ্গে ত্বকের সঠিক যত্নের অভাব এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের অনুপস্থিতি শীতকালে ত্বকের শুস্কতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ঠোঁট ফাটার সমস্যা ছাড়াও ত্বকের ফাটা অনেক সময় অস্বস্তিকর এবং ব্যথাদায়ক হতে পারে। 

এই নিবন্ধে আমরা শীতকালে ঠোঁট ও ত্বক ফেটে যাওয়ার কারণসমূহ, এর প্রতিকার, এবং কিভাবে সঠিক যত্নের মাধ্যমে এই সমস্যাকে এড়িয়ে চলা যায় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। 

আরো পড়ুনঃ প্রতিদিনের খাবারে পুষ্টি নিশ্চিত করার ১০টি সহজ উপায় 

শীতকালে বায়ুমণ্ডলে আর্দ্রতার পরিমাণ কমে যায়, ফলে আমাদের ত্বক এবং ঠোঁট শুষ্ক হয়ে যায়। আর্দ্রতার অভাবে ত্বক তার প্রাকৃতিক তেল ধরে রাখতে পারে না, যা ঠোঁট ও ত্বক ফেটে যাওয়ার মূল কারণগুলোর একটি। 

শীতকালে আমরা গরম পানি দিয়ে গোসল করতে পছন্দ করি। গরম পানি ত্বকের প্রাকৃতিক তেল দূর করে ত্বককে আরও শুষ্ক করে ফেলে, যা ঠোঁট ও গায়ের চামড়া ফাটার একটি বড় কারণ। 

৩। ঠাণ্ডা বাতাসঃ 

ঠাণ্ডা বাতাস সরাসরি ত্বকে আঘাত করে, ফলে ত্বকের আর্দ্রতা দ্রুত হারায়। বিশেষত যারা বাইরে বেশি সময় কাটান, তাদের জন্য এটি একটি সাধারণ সমস্যা। 

৪। সঠিক যত্নের অভাবঃ 

শীতকালে ত্বকের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন হয় আরও বেশি। সঠিকভাবে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার না করলে এবং ত্বককে আর্দ্র না রখলে ঠোঁট এবং ত্বক সহজেই ফেটে যায়। 

শীতকালে অনেকেই পর্যাপ্ত পানি পান করেন না, যা শরীরের ভিতরে শুষ্কতার সৃষ্টি করে। এতে ত্বকের আর্দ্রতা হ্রাস পায়, যা ঠোঁট ও ত্বক ফাটার অন্যতম কারণ। 

ঠোঁটের ত্বক অনেক সংবেদনশীল এবং শীতকালে তা দ্রুত শুষ্ক হয়ে যায়। লিপ বাম বা ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার না করলে ঠোঁট ফেটে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। 

৭। বয়স এবং স্বাস্থ্যগত সমস্যাঃ 

বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আর্দ্রতা ধরে রাখার ক্ষমতা কমে যায়। এছাড়াও, ডায়াবেটিস বা থাইরয়েডের মতো স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে ত্বক ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। 

নিয়মিত ত্বক এবং ঠোঁটে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করলে ত্বক শুষ্কতা থেকে রক্ষা পায়। বিশেষত শীতে, বডী লোশন, ক্রিম, এবং লিপ বাম ব্যবহার করা জরুরি। 

২। হিউমিডিফায়ার ব্যবহারঃ 

বাড়ির অভ্যন্তরে আর্দ্রতা বাড়াতে হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করলে ত্বকের শুষ্কতা কমাতে সাহায্য করে। এটি বায়ুর আর্দ্রতা বাড়িয়ে ত্বককে আর্দ্র রাখে। 

ঠাণ্ডা আবহাওয়া থেকে ত্বককে রক্ষা করার জন্য স্কার্ফ বা মাফলার দিয়ে মুখ ও ঠোঁট ঢেকে রাখা উচিত। এতে ঠাণ্ডা বাতাস ত্বকের ক্ষতি করতে পারে না। 

শীতকালেও পর্যাপ্ত পানি পান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শরীরের আর্দ্রতা বজায় রাখতে কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস পানি প্রতিদিন পান করা উচিত। 

পুষ্টিকর খাবার খেলে ত্বকের স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। বিশেষ করে ভিটামিন এ, সি, ই সমৃদ্ধ খাবার, যেমনঃ গাজর, পালং শাক, কমলা, এবং বাদাম ইত্যাদি খেলে ত্বকের আর্দ্রতা বজায় থাকে। 

৬। হালকা গরম পানি ব্যবহারঃ 

গরম পানির পরিবর্তে হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করলে ত্বকের প্রাকৃতিক তেল রক্ষা পায়, যা শীতকালে ত্বকের শুষ্কতা প্রতিরোধ করতে সহায়ক। 

৭। লিপ বাম এবং লোশন ব্যবহারঃ 

শীতে ত্বককে ময়েশ্চারাইজ করতে পেট্রোলিয়াম জেলি বা লিপ বাম ব্যবহার করে খুবই কার্যকরী। লিপ বাম ঠোঁটকে আর্দ্র রাখতে সাহায্য করে এবং ঠোঁটের ফাটাকে প্রতিরোধ করে। 

৮। প্রাকৃতিক তেল ব্যবহারঃ 

নারকেল তেল, বাদাম তেল, এবং অলিভ অয়েলের মতো প্রাকৃতিক তেল ত্বকে নিয়মিত ব্যবহারে ত্বক শুষ্কতা থেকে মুক্তি পায়। এগুলো প্রাকৃতিকভাবে ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখে। 

১। চেহারায় অনুজ্জ্বলতাঃ 

শীতে ত্বক ও ঠোঁট শুষ্ক হয়ে গেলে মুখের চেহারায় এক ধরনের অনুজ্জ্বল ভাব আসে। ত্বক তার স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা হারায় এবং তা নিস্তেজ দেখায়। ঠোঁট ফেটে গেলে তা আরও বেশি অস্বস্তির কারণ হতে পারে। 

২। ত্বকের সংবেদনশীলতা বৃদ্ধিঃ 

শীতকালে শুষ্ক ত্বক আরও সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। এর ফলে চুল্কানি, লালচে ভাব, এবং কখনো কখনো ফোসকা বা ক্ষতও হতে পারে। যাদের ত্বক আগে থেকেই সংবেদনশীল, তাদের জন্য এই সমস্যা আরও গুরুতর হতে পারে। 

৩। অস্বস্তি ও ব্যথাঃ 

ঠোঁট বা গায়ের চামড়া ফাটার ফলে তিব্র অস্বস্তি এবং কখনো কখনো ব্যথা হতে পারে। ঠোঁট ফাটার কারণে হাসা বা কথা বলার সময়ও ব্যথা হতে পারে। ত্বক ফাটার কারণে চলাফেরায় অস্বস্তি হয়।

৪। সংক্রমণের ঝুঁকিঃ 

ফাটা ত্বক এবং ঠোঁটের মাধ্যমে জীবাণু সহজেই প্রবেশ করতে পারে। এর ফলে ত্বকের ক্ষত আরও গুরুতর হতে পারে এবং সংক্রামণের ঝুকি থাকে। ঠোঁট ফাটলে বা রক্তপাত হলে তা অবহেলা না করে তাড়াতাড়ি যত্ন নেওয়া উচিত। 

আরো পড়ুনঃ মাথার খুশকিঃ খুশকি থেকে মুক্তি পাওয়ার ঘরোয়া সমাধান 

১। মধু ও গ্লিসারিনঃ 

মধু প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে এবং ত্বকের শুষ্কতা দূর করে। মধু এবং গ্লিসারিন মিশিয়ে নিয়মিত ব্যবহার করলে ঠোঁট ও ত্বকের শুষ্কতা অনেকটা কমে যায়। 

২। অ্যালোভেরা জেলঃ 

অ্যালোভেরা ত্বকের জন্য খুবই উপকারী। এটি ত্বককে প্রশান্তি দেয় এবং শুষ্কতা কমায়। শীতে ত্বকের যত্নে অ্যালোভেরা জেল নিয়মিত ব্যবহার করলে ত্বক নরম ও মসৃণ থাকে। 

৩। নারকেল তেলঃ 

নারকেল তেল ত্বককে প্রাকৃতিকভাবে আর্দ্র রাখে। শীতে ঠোঁট ও ত্বকের শুষ্কতা দূর করতে নারকেল তেল সরাসরি ত্বকে ব্যবহার করা যায়। এতে ত্বক ফাটা ফাটা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। 

৪। দুধ ও মধুঃ 

দুধ এবং মধুর মিশ্রণ ত্বকের জন্য খুবই কার্যকর। দুধে থাকা ল্যাকটিক অ্যাসিড ত্বকের শুষ্কতা কমাতে সাহায্য করে এবং মধু ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সহায়ক। 

৫। শসার রসঃ 

শসার রস ত্বককে প্রাকৃতিকভাবে আর্দ্র রাখে এবং শুষ্কতা দূর করতে সাহায্য করে। শসার রস ঠাণ্ডা এবং শীতল, যা ত্বকের শুষ্কতা কমিয়ে আরাম দেয়। 

১। ত্বকে অতিরিক্ত স্ক্রাব না করাঃ 

শীতে ত্বক এমনিতেই শুষ্ক হয়ে থাকে। অতিরিক্ত স্ক্রাব করলে ত্বকের প্রাকৃতিক তেল দূর হয়ে যেতে পারে, যা ত্বককে আরও শুষ্ক করে তোলে। তাই মৃদু স্ক্রাব ব্যবহার করা উচিত। 

২। সুগন্ধিযুক্ত প্রসাধনী এড়িয়ে চলাঃ 

শীতে সুগন্ধিযুক্ত প্রসাধনী ব্যবহার করলে ত্বকের শুষ্কতা আরও বেড়ে যেতে পারে। এই ধরনের প্রসাধনী ত্বকের আর্দ্রতা কমিয়ে দেয়, ফলে ত্বক আরও বেশি ফাটার সম্ভাবনা থাকে। 

৩। ঠোঁট চাটা থেকে বিরত থাকাঃ 

অনেকেই শীতকালে ঠোঁট শুষ্ক হলে বারবার ঠোঁট চাটেন, যা ঠোঁটের শুষ্কতা আরও বাড়িয়ে দেয়। এতে ঠোঁট আরও বেশি ফাটে এবং ব্যথা অনুভূতি হয়। এজন্য ঠোঁটে লিপ বাম বা পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার করা উচিত। 

শীতকালে শিশুদের ত্বক খুবই সংবেদনশীল হয়ে থাকে। তাদের ত্বক যাতে শুষ্ক না হয়, এজন্য বিশেষ যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন। তাদের নিয়মিত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করানো উচিত এবং ত্বককে শীতের ঠাণ্ডা বাতাস থেকে রক্ষা করতে তাদের তাপমাত্রা অনুযায়ী পোশাক পরানো উচিত। 

বয়স্কদের ক্ষেত্রেঃ 

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্বক শুষ্ক হয়ে পড়ে এবং তার স্বাভাবিক মসৃণতা হারায়। শীতকালে বয়স্কদের ত্বকের যত্নে বিশেষ মনোযোগ  দেওয়া প্রয়োজন। ত্বকে নিয়মিত তেল বা ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার এবং পর্যাপ্ত পানি পান করার মাধ্যমে তাদের ত্বককে শুষ্কতা থেকে রক্ষা করা যায়। 

আরো পড়ুনঃ মাত্র ৭ দিনে মোটা হওয়ার গোপন রহস্যঃ মোটা হওয়ার ১০টি কার্যকরী উপায় 

১। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবারঃ 

ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ত্বককে আর্দ্র রাখতে সাহায্য করে। স্যামন মাছ, ছিয়া সিড, এবং আখরোটের মতো খাবারে প্রচুর ওমেগা-৩ থাকে, যা শীতে ত্বকের শুষ্কতা দূর করতে সহায়ক। 

২। জলপাই তেল ও বাদামঃ 

জলপাই তেল এবং বাদামে ভিটামিন ই থাকে, যা ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখতে সহায়ক। শীতকালে এই ধরনের খাবার খেলে ত্বকের শুষ্কতা কমে এবং ত্বক নরম ও মসৃণ থাকে। 

৩। পর্যাপ্ত সবুজ শাকসবজিঃ 

সবুজ শাকসবজিতে প্রচুর ভিটামিন এবং মিনারেলস থাকে, যা ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। পালং শাক, ব্রোকোলি, এবং অন্যান্য সবুজ শাকসবজি ত্বককে শুষ্কতা থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। 

১। সপ্তাহে দুইবার এক্সফোলিয়েশনঃ 

ত্বকের মৃত কোষ সরিয়ে ফেলার জন্য সপ্তাহে দুইবার মৃদু স্ক্রাব ব্যবহার করা উচিত। এটি ত্বককে নরম এবং মসৃণ রাখতে সহায়ক। 

২। সানস্ক্রিন ব্যবহারঃ 

শীতকালে সূর্যের আলোর কারণে ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই শীতে বাইরে বেরোনোর সময় সানস্ক্রিন ব্যবহার করা উচিত। 

৩। স্বাস্থ্যকর রুটিনঃ 

নিয়মিত সঠিক ঘুম এবং স্বাস্থ্যকর রুটিন বজায় রাখলে ত্বকের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে এবং ফাটার সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। 

গরম কাপড় পরার পাশাপাশি ত্বক যাতে ঠিকভাবে শ্বাস নিতে পারে, সেজন্য হালকা এবং প্রাকৃতিক কাপড় পড়া উচিত। 

৫। মুখ ধোয়ার পর ভালোভাবে মুছে ফেলাঃ 

মুখ ধোয়ার পর ত্বককে ভালোভাবে মুছে নেওয়া উচিত এবং সঙ্গে সঙ্গেই ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত, যাতে ত্বক শুষ্ক না হয়। 

আরো পড়ুনঃ মাত্র ৩০ দিনে ওজন কমানোর কার্যকর উপায় 

শীতকালে ঠোঁট ও ত্বক ফেটে যাওয়া একটি স্বাভাবিক সমস্যা হলেও সঠিক যত্ন এবং প্রতিকার নেওয়ার মাধ্যমে এটি সহজেই প্রতিরোধ করা যায়। শুষ্ক আবহাওয়া, ঠাণ্ডা বাতাস, এবং শরীরের পর্যাপ্ত আর্দ্রতা বজায় রাখতে না পারার কারণে এই সমস্যা দেখা দেয়। তবে নিয়মিত ময়েশ্চারাইজার, লিপ বাম, এবং প্রাকৃতিক তেল ব্যবহার করে ত্বক ও ঠোঁটকে শীতের শুষ্কতা থেকে রক্ষা করা সম্ভভব। 

এছাড়াও সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত পানি পান, এবং ত্বকের প্রতি মনোযোগী হওয়ার মাধ্যমে শীতে সুস্থ, উজ্জ্বল, এবং আর্দ্র ত্বক ধরে রাখা যায়। ত্বকের শুষ্কতা শুধু চেহারায় অনুজ্জ্বলতা এনে দেয় না, বরং সংক্রমণ এবং অন্যান্য সমস্যার কারণ হতে পারে। তাই সতর্কতা এবং নিয়মিত যত্নের মাধ্যমে এ সমস্যা এড়িয়ে চলা সম্ভব। 

সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে আমরা শীতকালে ত্বক ও ঠোঁটের ফাটার সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি এবং সুস্থ ও সতেজ ত্বক উপভোগ করতে পারি।