হিটলারের রক্তাক্ত ইতিহাসঃ নাৎসি শাসনের অধীনে সংঘটিত ইতিহাস

Sabbir Space💲

23 Oct, 2024

হিটলার (আডলফ হিটলার) ছিল জার্মানির নাৎসি পার্টির নেতা এবং ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জার্মানির চ্যান্সেলর। তিনি ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত এবং নির্মম রাজনৈতিক নেতাদের একজন হিসেবে পরিচিত।

নিচে হিটলারের জীবন, কর্ম এবং তার শাসনকাল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হলোঃ

আরো পড়ুনঃ রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধঃ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকট

জন্ম ও শৈশব

জন্মঃ ২০ এপ্রিল, ১৮৮৯ সালে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির ব্রাউনাউ অ্যাম ইন শহরে জন্মগ্রহন করেন।
তার বাবা অ্যালোকাস হিটলার ছিলেন একজন শুল্ক কর্মকর্তা এবং মা ক্লারা হিটলার ছিলেন একজন গৃহবধূ।
শৈশব থেকেই হিটলারের জীবনে একাধিক পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত ছিল। তার শিল্পকলায় আগ্রহ ছিল, কিন্তু পরিবারের চাপ ও জীবনের সংকট তাকে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার দিকে নিয়ে যায়।

প্রাথমিক রাজনৈতিক জীবন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধঃ ১৯১৪ সালে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। যুদ্ধের সময় হিটলার একাধিকবার আহত হন এবং পদকও লাভ করেন।
যুদ্ধের পরে, জার্মানির ভেঙে পড়া অর্থনীতি ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে, হিটলার মিউনিখে চলে আসেন এবং জার্মান শ্রমিকদের সংগঠন করা শুরু করেন।

নাৎসি পার্টি গঠন

১৯২০ সালে হিটলার জার্মান ওয়ার্কাস পার্টিতে যোগ দেন, যা পরবর্তীতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক জার্মান শ্রমিক পার্টি (নাৎসি পার্টি) হিসেবে পরিচিত হয়।
১৯২৩ সালে হিটলার বিয়ার হল পুটশ নামে একটি অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেন, যা ব্যর্থ হয় এবং তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। কারাগারে থাকাকালীন তিনি তার আত্মজীবনী ও রাজনৈতিক মতবাদসমূহ নিয়ে "মাইন কাম্পফ" (আমার সংগ্রাম) বইটি লেখেন।

ক্ষমতায় আরোহণ

১৯৩৩ সালে জার্মানির রাষ্ট্রপতি পল ভন হিন্ডেনবার্গ হিটলারকে চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ করেন।
হিটলার ধীরে ধীরে পুরো জার্মানির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন, এবং ১৯৩৪ সালে হিন্ডেনবার্গের মৃত্যুর পর তিনি রাষ্ট্রপতির পদও নিজের হাতে নেন, "ফুয়েরার" (নেতা) উপাধি গ্রহন করেন।

নাৎসি শাসনকাল

হিটলার শাসনের শুরুতেই জার্মানির অর্থনৈতিকে পুনরুদ্ধার করতে এবং সামরিক শক্তিকে বৃদ্ধি করতে উদ্যোগ নেন।
তার সবচেয়ে কুখ্যাত কাজ ছিল ইহুদি, রোমা, সমকামী, শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষ এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে গনহত্যা চালানো। এই গণহত্যা হলোকাস্ট নামে পরিচিত, যেখানে ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

১৯৩৯ সালে হিটলারের নির্দেশে জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমন করে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়।
যুদ্ধের প্রথম দিকে হিটলার বড় ধরনের সফলতা পান, ইউরোপের অনেক দেশ তার নিয়ন্ত্রনে চলে আসে।
তবে, ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর আক্রমণ এবং ১৯৪৪ সালের নির্মম আক্রমণের পড়ে যুদ্ধের মোড় পাল্টাতে শুরু করে।

পতন ও মৃত্যু

১৯৪৫ সালে মিত্রবাহিনীর আক্রমণ এবং জার্মানির ক্রমাগত পতনের কারণে, হিটলারের অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।
৩০ এপ্রিল, ১৯৪৫ সালে বার্লিনের একটি বাংকারে হিটলার এবং তার স্ত্রী ইভা ব্রাউন আত্মহত্যা করেন।

হিটলারের মতবাদ

হিটলার ছিলেন একজন উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং বর্ণবাদী।
তার মতবাদ অনুযায়ী, আর্য জাতি ছিল শ্রেষ্ঠ এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী, বিশেষ করে ইহুদিরা, ছিল দোষী এবং তাদের নিঃশেষ করতে হবে।

প্রভাব ও ঐতিহাসিক মূল্যায়ন

হিটলারের শাসন বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে অন্ধকারময় অধ্যায়গুলোর মধ্যে অন্যতম। তার কাজের ফলেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, যেখানে ৬০ লক্ষের বেশি মানুষ মারা যায়।
তার শাসনের নৃশংসতা এবং নির্মমতার জন্য তিনি ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুর শাসক হিসেবে চিহ্নিত।

হিটলারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য

বক্তৃতার দক্ষতাঃ হিটলার ছিলেন একজন প্রভাবশালী বক্তা। তার বক্তৃতাগুলো মানুষকে উদ্বুদ্ধ করত এবং তিতি তার রাজনৈতিক মতবাদকে ছড়িয়ে দিতে এই দক্ষতাকে চমৎকারভাবে ব্যবহার করতেন।
চরম শৃঙ্খলাবদ্ধতাঃ হিটলার সবসময় নিজের জীবনকে অত্যন্ত নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে পরিচালনা করতেন। তিনি ধূমপান বা মদ্যপান করতেন না এবং নিরামিষাশী ছিলেন।
উগ্র জাতিয়তাবাদঃ হিটলারের মনে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি গভীর আস্থা ছিল। তিতি আর্য জাতিকে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে নিকৃষ্ট ভাবতেন।

রাজনৈতিক সাফল্য ও ব্যর্থতা

রাজনৈতিক শক্তির কৌশলঃ হিটলার তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ধীরে ধীরে সরিয়ে নিজের শক্তি বাড়ান। তিনি মিডিয়া, শিক্ষা, এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসেন।
প্রোপাগান্ডা মেশনঃ হিটলারের মন্ত্রী জোসেফ গোয়েবেলসের নেতৃত্বে নাৎসি জার্মানি একটি শক্তিশালী প্রোপাগান্ডা ব্যবস্থা চালু করে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা নিজেদের আদর্শ প্রচার করত এবং জনগণকে প্রভাবিত করত।

হিটলারের সামরিক কৌশল

ব্লিটজক্রিগঃ হিটলার একটি দ্রুত এবং মারাত্মক যুদ্ধ কৌশল তৈরি করেন, যা "ব্লিটজক্রিগ" নামে পরিচিত। এটি মূলত বায়ু, স্থল, এবং ট্যাংক বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মধ্যমে শত্রুর উপর দ্রুত বিজয় লাভের কৌশল।
রাশিয়ার অভিজানঃ ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর আক্রমণ (অপারেশন বারবারোসা) হিটলারের একটি প্রধান ভুল ছিল। শীতকালীন পরিস্থিতি এবং সোভিয়েত বাহিনীর প্রতিরোধ হিটলারের বাহিনিকে বড় ধরনের পরাজয়ের সম্মুখীন করে।

হলোকাস্ট ও নাৎসি নীতি

হিটলারের শাসনকালে ইহুদিদের প্রতি তার ঘৃণা এবং বিদ্বেষ তাকে "ইহুদি প্রশ্নের চূড়ান্ত সমাধান" (The Final Solution) নামে পরিচিত গনহত্যা চালাতে উদ্বুদ্ধ করে। এই পরিকল্পনার অধীনে, লক্ষ লক্ষ ইহুদি, জিপসি, প্রতিবন্ধি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নাৎসি বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নাৎসি প্রভাব

বিজ্ঞানঃ হিটলারের সময়ে জার্মানিতে অনেক বিজ্ঞানি এবং প্রকৌশলী কাজ করতেন, বিশেষ করে অস্ত্র এবং মহাকাশ গবেষণায়। যেমন, ভানার ভন ব্রাউন পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করে রকেট প্রযুক্তিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেন।
প্রজুক্তিঃ হিটলারের জার্মানি আধুনিক অস্ত্র, ট্যাংক, সাবমেরিন এবং বিমান উন্নয়নে অনেক দূরে এগিয়ে ছিল।

হিটলারের পতন ও প্রভাব

পতনের কারণঃ যুদ্ধের শেষদিকে হিটলার বড় ধরনের কৌশলগত ভুল করেন। মিত্রবাহিনীর শক্তিশালী প্রতিরোধ এবং রাশিয়ার শীতল আবহাওয়া তার বাহিনীকে দুর্বল করে দেয়।
আত্মহত্যাঃ ৩০ এপ্রিল ১৯৪৫ সালে, হিটলার বার্লিনের বাঙ্কারে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন। তার স্ত্রী ইভা ব্রাউনও তার সাথে বিষ পান করে আত্মহত্যা করেন।

শেষকথা

হিটলারের জীবন ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আরও বিশদ জানতে, তার লেখা বই "মাইন কাম্পফ" এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর নানা ঐতিহাসিক নথিপত্র পড়া যেতে পারে, তবে তার ভয়াবহ আদর্শ থেকে শিক্ষা নিয়ে মানবতার মূল্যবোধ রক্ষায় সতর্ক থাকা জরুরি।